কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

নড়াইলেও কথা হচ্ছে। সারা দেশের মতো নড়াইলেও দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, টেন্ডারবাজি, পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে দলীয় কোন্দল, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এমনকি আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েও। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে কম ভোট পেয়েও বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করেছেন।


স্থানীয় ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্রলীগের সমর্থক বেশি। কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কোন কালে হয়েছে তা অনেকের মনেও নেই। ছাত্রলীগের নেতাগোছের একজন থেকে জানা গেল, নির্বাচন না হলেই ভালো। সাত-আটটা গ্রুপকে এক ঘাটে বাঁধার মতো প্রভাবশালী নেতা নেই। সুতরাং নির্বাচন হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। নড়াইলে বিএনপির সংসদে না যাওয়া নিয়েও কথা হচ্ছে। সামান্য কয়েকজন সদস্য নিয়েও বিএনপি যেভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করছে, তা দুশ্চিন্তার কারণ তো বটেই; আগামী সংসদে হয়তো বিএনপির সদস্যসংখ্যা বাড়বে। তখন অবজ্ঞার মাত্রাও বেড়ে যাবে। বিএনপির আহূত অহেতুক হরতাল নিয়েও কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে বাড়ি এবং পুত্রের সম্পদ রক্ষায় নিবেদিত রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অবান্তর বক্তৃতা এবং অন্যান্য বিষয়, স্থানীয় নায়ক মাশরাফির দলে না থাকা ইত্যাদি নিয়েও নড়াইলে কথা হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা বোধ হয় নড়াইল। আমার প্রিয় শহরগুলোর অন্যতম এই ছোট্ট জেলা শহরের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নিস্তরঙ্গ এক রোমান্টিক নদী_চিত্রা। শিল্পোন্নয়ন না হওয়ায় চিত্রার জল আজও টলটলে এবং প্রচুর মিঠাপানির মাছও আছে এই নদীতে। শহরের টার্মিনাল বাজারে প্রতি বিকেলে নানা জাতের তাজা মাছ দেখে স্মৃতিতাড়িত হয়েছি। আমার জন্মশহর ফরিদপুরের কুমার নদেও একসময় এ রকম মৎস্যসম্ভার ছিল। দেশের অন্যান্য বিখ্যাত নদীর চেয়ে চিত্রাকে এখনো স্রোতস্বিনী দেখে ভালো লাগল। নড়াইলের আর যে কয়টি নদী যেমন_মধুমতি, নবগঙ্গা এবং কাজলার অবস্থা কিন্তু চিত্রার মতো নয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নড়াইলেও কথা হচ্ছে কতিপয় মন্ত্রীর অবান্তর ও লাগামহীন কথা বলা নিয়ে। কয়েকজন তো অভিযোগের সুরেই বললেন যে মন্ত্রী কথা বললেই জিনিসের দাম বেড়ে যায়। স্থানীয় এক কমিশনার বললেন এক সংসদ সদস্যের বিপক্ষে, যিনি নাকি নিজ স্বার্থে দলীয় প্রার্থীকে উপেক্ষা করে জামায়াত-শিবিরের লোককে কলেজের চাকরিতে ঢোকানোর চেষ্টা করেছেন। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ হয়নি এবং প্রয়োজনও বোধ করিনি। নড়াইলের এই চিত্র তো দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। নড়াইলে শেষ যে বছর এসেছি, বছর ১২-১৪ আগে, ওই সময়ের চেয়ে শহরের চেহারা খুব একটা বদলায়নি। নতুন কিছু বাড়িঘর উঠেছে আর কিছু নতুন রাস্তা হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে মাগুরা, মাওয়া, ফরিদপুর কিংবা খুলনার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। তখন এখানে জেলা প্রশাসক ছিলেন আমার পরিচিত, যিনি ষাটের দশকে ফরিদপুরের ছাত্ররাজনীতিতে আমার সহকর্মী ছিলেন। সেবার আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী বারীণ ভট্টাচার্যকেও পেয়েছিলাম। তখন তিনি একজন স্থানীয় নামজাদা উকিল। বারীণের পিতামহ এবং পিতামহী উভয়েই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। বারীণদের পুরনো বাড়িতে নেতাজির সঙ্গে তাঁদের ছবিও দেখেছি। সেই বারীণকে এবারে নড়াইলে খুঁজে পেলাম না। শোনলাম, স্থানীয় নব্য দাপুটে লোকদের কৌশলী চাপে পুরনো পৈতৃক ভিটা এবং অন্যান্য সম্পত্তি দখলে না রাখতে পেরে দেশত্যাগী হয়েছেন। এ রকম ঘটনা খোঁজ নিলে হয়তো আরো পাওয়া যাবে। অর্পিত সম্পত্তি আইনের জটিলতা বারীণের মতো অনেককেই দেশছাড়া করেছে এবং করছে। বিষয়টা দুঃখজনক।
নড়াইলে প্রথম এসেছিলাম একাত্তরের মার্চে, বোধ হয় বাইশ তারিখে। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে আমরা ফরিদপুর অঞ্চলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের কৌশল ও পরিকল্পনা নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক তখন আ ন ম ইউসুফ, যিনি আমাদের কর্মপরিকল্পনার নেপথ্য সহযোগী ছিলেন। রাজবাড়ীর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন শাহ ফরিদ। মাদারীপুরে সৈয়দ রেজাউল হায়াত। জেলার কাছাকাছি নড়াইলের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কামাল সিদ্দিকী। প্রশাসনের এসব ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনা যখন প্রহসনের দিকে মোড় নিচ্ছিল, তখন দেশজুড়ে মুক্তিকামী জনতার কর্মতৎপরতাও দিনে দিনে তীব্রতর হচ্ছিল। বিশেষ করে ছাত্রদের তখন অবসরের ফুরসৎ ছিল না। দিন-রাত নির্ঘুম টেনশনে ছিলাম। এ রকমই একটা সময়ে খবর দেওয়া-নেওয়ার প্রয়োজনেই আমাকে ফরিদপুর থেকে নড়াইল যেতে হয়েছিল। নৌকায় মধুমতি পাড়ি দিতে অনেকটা সময় লেগেছিল। এতই বড় ছিল তখন মধুমতি নদী। চিত্রা নদীও তখন পূর্ণ যুবতী। শান্ত শহরটিতে জনমনে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা। তবুও তারা কী ভীষণ অতিথিপরায়ণ। নড়াইলকে খুব ভালো লেগেছিল সেদিন প্রথম দর্শনেই। বাম রাজনীতি চর্চায় নড়াইলের অবস্থান ছিল বেশ এগিয়ে। এদেরই একটা অংশ বোধ হয় ভ্রান্ত রাজনীতির পথ ধরে তথাকথিত নকশাল নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছে। আজও এদের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেনি। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে এদের অপতৎপরতা বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয়রা।
নড়াইলের সংস্কৃতি চর্চার সুনাম আছে। শিল্পী এস এম সুলতান এ অঞ্চলের সব মানুষের অহংকারের নাম। বিচ্ছেদ গানের অমর গায়ক বিজয় সরকারের গানও সবার কণ্ঠে। তা ছাড়া এ অঞ্চলেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উদয়শঙ্করদের আদিবাড়ি_যা এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের পৈতৃক ভিটাও এখানে। নড়াইলের চিত্রা থিয়েটার বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের একটি অন্যতম নাট্যসংগঠন। অনেক বছর ধরেই এ সংগঠনটি নিয়মিত নাট্যকার্যক্রমের মাধ্যমে দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। স্থানীয় সামাজিক কর্মকাণ্ডে তারা নেতৃত্বও দিয়ে থাকে। নমস্য শিল্পী এস এম সুলতানের বাড়িটিকে সরকারিভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে_যেখানে শিল্পীর রুচি, দর্শন, পছন্দের চিহ্নমাত্র নেই। নিছক ইট-সিমেন্টের একটি অশৈল্পিক ভবন মাত্র। শিল্পীর নিজ হাতে লাগানো ফল ও ফুলের গাছগুলো অবশ্য আগের মতোই আছে। অপত্যস্নেহে পালিত পশুপাখিগুলো কোথায় উধাও। কোমলমতি শিশুদের নিয়ে তিনি যে শিশুস্বর্গ গড়তে চেষ্টা করেছিলেন, সেটা এখন সরকার নিয়ন্ত্রিত আর দশটা স্কুলের মতোই একটা স্কুল। শিল্পীর নামে একটি আর্ট কলেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কলেজের নামের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির নামও সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব নিয়ে স্থানীয় সুধী সমাজে কথা হচ্ছে। শিল্পী সুলতান কেবলই ছবি এঁকেছেন তাঁর নিজস্ব ঘরানায়, ছবি নিয়ে কখনো বাণিজ্যের কথা ভাবেননি। অথচ মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে কতই না বাণিজ্য। শিল্পী সুলতান জীবনে কত ছবি এঁকেছেন! ছবিগুলো কাদের কাছে সংরক্ষিত আছে! ছবিগুলো যথার্থভাবে সংরক্ষিত হয়েছে তো! অযত্ন কিংবা অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায়নি তো! এসবের উত্তর আমার জানা নেই। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক রবিউল ইসলামের কাছ থেকে জেনেছি, কলেজের হেফাজতে শিল্পী সুলতানের আঁকা দুটি ছবি আছে। প্রতিবছর নড়াইলে অনুষ্ঠিত সুলতান মেলার চরিত্র, আঙ্গিক এবং নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে কথা হয়, কথা হচ্ছে। মেলাটি যদি কেবলই আনুষ্ঠানিকতার দায়ে শ্রীহীন, অর্থহীন ও রুচিহীন হয়ে পড়ে, তবে তো তা দুঃখজনক হবে।
জয় বাংলা।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.