সিসিসি নির্বাচন-স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় রাজনীতি by মশিউল আলম

সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর এক সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সংবাদকর্মীদের একজন বললেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী মনোয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় আসার আগেই নিজের
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপির প্রার্থী এম মঞ্জুর আলমের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’
মহিউদ্দিন চৌধুরী উত্তরে বললেন, এতে তিনি অবাক হননি। কারণ জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন করবে এটাই স্বাভাবিক। আরেক সংবাদকর্মী জানালেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী মনোয়নপত্র প্রত্যাহার করবেন না বলে তিনি জেনেছেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, ‘তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবেন কি করবেন না, সেটা তাঁর ব্যাপার। তাঁর দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি প্রত্যাহার করতে বলে তাহলে প্রত্যাহার করবেন, না বললে করবেন না।’
‘উনি তো নিজে প্রত্যাহার করবেনই না, বরং উনি বলেছেন, আপনি যেন নিজের মনোনয়নপত্রটা প্রত্যাহার করে উনাকে সাপোর্ট করেন।’ ওই সংবাদকর্মীর এ হেন কথায় খানিক হাস্যরসের সৃষ্টি হলো। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরীর মুখমণ্ডল রয়ে গেল আগের মতোই অভিব্যক্তিহীন। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘যদি আমার দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাকে সেটা করতে বলে, আমি তা-ই করব।’
অবিশ্বাস্য কথা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি কতখানি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য এমন কথা বলা যেতে পারে! প্রেস ব্রিফিং শেষ হলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে এক মিনিট সময় চাইলে তিনি সম্মতি দিলেন।
‘আপনার দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আপনাকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন করতে বললে আপনি কি সত্যিই তাই করবেন?’ আমার এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হলে আমি কাজ করব নির্দলীয়ভাবে। আমি তখন সকলের মেয়র। নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধা, নগরের উন্নয়ন—এসব হবে আমার কাজ। সেখানে কোনো দলের ব্যাপার থাকবে না।’
কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থিতা কেন দলের সিদ্ধান্তের ওপরেই সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে? যে নির্বাচনে প্রার্থীদের দলের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয় না, যে নির্বাচনের প্রচারণায় দলীয় নেতানেত্রীর ছবি ব্যবহার করা বা দলের নামে স্লোগান দেওয়া আইনত নিষিদ্ধ, যে নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, তার প্রার্থী মনোনয়নের অলিখিত, কিন্তু চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে?
একই জিজ্ঞাসা নিয়ে সোমবার সন্ধ্যার পরে হাজির হয়েছিলাম নগরের মেহেদীবাগে বিএনপির মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী এম মঞ্জুর আলমের নির্বাচনী কার্যালয়ে। চট্টগ্রামে অতিশয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও বেশ বিনয়ী মানুষ বলে পরিচিত এই ভদ্রলোক সারা জীবন সম্পৃক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে, ছিলেন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রীতিভাজন একজন সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর, পালন করেছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব। শুধু এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্যই তিনি দল পরিবর্তন করেছেন; বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে নিজেদের মনোনীত প্রার্থী বলে ঘোষণা করে দলের সব নেতা-কর্মীকে তাঁর সমর্থনে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
সোমবার সন্ধ্যায় তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে তাঁকে ঘিরে ছিলেন অন্যান্যের মধ্যে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক; আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া শুরু করলেন তাঁরাই। মিতভাষী মঞ্জুর আলম স্মিতহাসি মুখে নিয়ে বসে রইলেন; তাঁর সমর্থক অধ্যাপকেরা একের পর এক বলে চললেন অনেক কথা। সেসবের মধ্যে তাঁর জনমুখী কৃতকর্মের বিবরণও: তিনি কতটি কলেজ, কতটি বিদ্যালয়, কত মসজিদ, কত মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন, কত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, কত মানুষকে কতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন ইত্যাদি।
মঞ্জুর আলমকে বললাম, ‘আপনার এসব মহৎ কর্মই কি মেয়র পদে আপনার প্রার্থী হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না? কেন নিজের দল ছেড়ে বিরুদ্ধ মতের একটি রাজনৈতিক দলে ভিড়তে হলো আপনাকে?’
এবারও তিনি কিছু বলার আগেই একজন অধ্যাপক বললেন, মেয়র নির্বাচন করার জন্য তিনি দল বদল করেননি। এর আগে তিনি সংসদ নির্বাচনও করেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। বেশ আঁঁকাবাঁকা কথাবার্তার শেষে তিনি ও সেখানে উপস্থিত সবাই স্বীকার করলেন, কোনো ব্যক্তি যত যোগ্য প্রার্থীই হোন না কেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচনে লড়তে হলে তাঁকে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেতেই হবে—এটা এ দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা। এর বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় কারোরই নেই।
কিন্তু কথা ছিল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হবে স্বাধীন, জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকবে না, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি জবাবদিহি করবেন তাঁদের ভোটারমণ্ডলীর কাছে, স্থানীয় জনগণের কাছে তাঁরা হবেন সহজগম্য; তাঁদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ থাকবে স্থানীয় জনসাধারণের মতামত ও আশা-প্রত্যাশার প্রতি। অর্থাৎ স্থানীয় জনগণ বা ভোটারমণ্ডলীই হবেন তাঁদের নির্বাচনের ব্যাপারে সমস্ত কিছুর নির্ধারক। তাই জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক থাকার কথা নয়, অন্তত নির্বাচনের ব্যাপারে; কাগজে-কলমে সেটা নেইও। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার কোনো ধাপের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।
কিন্তু জাতীয় রাজনীতি, রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের শীর্ষ নেতাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব এতই প্রবল ও ব্যাপক-বিস্তারি যে সিটি করপোরেশনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতীক যা-ই হোক না কেন, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের অনুমোদন ছাড়া তাঁদের নির্বাচনে দাঁড়ানো হয় না।
এ বিষয়ে টেলিফোনে কথা হলো নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিধিবিধান মেনে চলা হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তৃত্বের ব্যাপারে কমিশন আর কী করতে পারে। দলগুলো প্রার্থী মনোনীত করছে, একজন প্রার্থীর পক্ষে দলীয়ভাবে জোটবদ্ধ হচ্ছে—এসবই হচ্ছে অনানুষ্ঠানিকভাবে। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির প্রার্থী, এম মঞ্জুর আলম চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের প্রার্থী। এগুলো রাজনৈতিক সংগঠন নয়, নাগরিক সংগঠন। তবে তিনি আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন যে এগুলো হলো ছদ্ম নাগরিক সংগঠন। নাগরিক কমিটির পেছনে আছে আওয়ামী লীগ আর চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের পেছনে আছে বিএনপি।
স্বাধীন শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থার পক্ষে জনমত গঠনের যে চেষ্টা চলছে, সর্বগামী-সর্বময় জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা সেই প্রয়াসকে এভাবে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। এম মঞ্জুর আলমকে জিজ্ঞেস বললাম, ‘একটি বড় রাজনৈতিক দলের অনুমোদন পেয়ে আনন্দিত চিত্তে আপনি নির্বাচনী লড়াইয়ে নামলেন। কিন্তু ওই দলটি তো এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই; সেখানে এখন তাদের প্রতিপক্ষরা। আপনি যদি মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে কি নিজের পরিকল্পনাগুলো স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন?’
তিনি বেশ আস্থার সঙ্গে বললেন, পারবেন, কারণ তিনি যা কিছু করবেন ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করে, সরকারের অনুমোদন নিয়েই করবেন। সরকার যা চাইবে না, তা তিনি করতে যাবেন না।
তাহলে কেন্দ্রীয় প্রভাবমুক্ত, শক্তিশালী, স্বাধীন, নাগরিকমুখী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা কি নিছক কথার কথাই থেকে যাবে? আরও কত দিন?
চট্টগ্রাম, ১ জুন
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.