গোধূলির ছায়াপথে-আমরা পারব না কেন? by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

‘ওই গানটি শুনেছি ষাটোত্তর বছর আগে, শচীন দেববর্মণের কণ্ঠে। কোন সালে রেকর্ড বলতে পারবেন?’ ফোনের অপরপ্রান্তে লতিফুল বারী অপেক্ষায়। আন্দাজ করে বললাম, আমার জন্মসালে, ১৯৩৭। বারী সাহেব বাংলা গানের অকৃত্রিম সমঝদার, সাবেক সচিব, গানবাজনাসংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করেন টেলিফোনে।


বললেন, এই সুন্দর গানগুলো আর শুনতে পাই না।
তাঁকে খুশি করে আরও জানালাম, কয়েক দিন আগে ছোট মেয়ের বাসায় গানের আসরে গানটি গাইতে শুরু করলে বড় ভাই কণ্ঠ মেলালেন। প্রধান বিচারপতি ছিলেন, কিন্তু গান যে তাঁর রক্তে। গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়িয়ে দুই ভাই পরমানন্দে গেয়ে ফেললাম, শচীন কর্তার ফেলে যাওয়া গান: ‘গোধূলির ছায়াপথে, যে গেল ফিরিল তারে প্রভাতের ফুলহাতে, সে তো এসেছিল দ্বারে’।
মেঘের আড়ালে বেলা হলে বেলার দোষ কী, মেঘেরই বা কোন অপরাধ? বেলা সে তো বয়ে যাওয়ার জন্য, কারও অপেক্ষার ধার ধারে না। আশা ভোঁসলে গান গাইতে বসেছেন আমেরিকার মায়ামি শহরের বিরাট স্টেডিয়ামে। কয়েক হাজার দর্শক, তিল ধারণের জায়গা নেই। ১০০ ডলারের টিকিট। তাহলে কী হবে? হট্টগোল থামানো যাচ্ছে না। আশা এবার মাইক্রোফোন হাতে নিলেন, বললেন, ‘আপলোক সব খামোশ হো যাইয়ে। ইয়াহাঁ ম্যায় সবসে বড়ি হুঁ।’ আশা পঁচাত্তর। সবাই এক মুহূর্তে ঠান্ডা।
নানা সভায় বেগতিক হলে আমিও তাই করি। মেনে নেন। আমার চেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি সংসারে আরও আছেন, তাঁদের কাছে নতজানু আমি, কান পেতে শুনছি। যারা এগিয়ে গেছে তাদের কাছে শিখতে দোষ কী? ১৯৮১ সালে মহাচীনে গিয়েছিলাম তিন সপ্তাহের জন্য। সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সহনেতা হিসেবে। ফিরে এসে অবজারভার পত্রিকায় লিখেছিলাম পনেরটি প্রবন্ধ। ‘চীন: কয়েকটি অবিস্মৃত মুহূর্তের স্মৃতি’। পাঠকদের অনেক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। সে সময় চীনে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন কজনই বা। বই লিখেছিলেন মওলানা ভাসানী, আবদুল আহাদ, শাহরিয়ার কবির ও ফেরদৌসী রহমান। এ মাসেই আবার চলেছি মহাচীনে ৩০ বছর পর ‘এশিয়ান মিডিয়া সামিট কনফারেন্স’-এ। দুটি সময় মিলিয়ে দেখলে কেমন হয়? ফিরে তাকালেই বোঝা যাবে, ওরা কতখানি শিখে এগিয়ে গেছে।
চীনা ভাষায় ‘ব্যস্ত’ শব্দটিতে দুটি অক্ষর, একটির অর্থ ‘হূদয়’, অপরটির অর্থ ‘ঘাতক’। জীবনের কত কাছাকাছি শব্দ দুটি। লক্ষ হূদয়ের স্পন্দন প্রতি দিবসে থেমে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার মতোই। আবার প্রতিটি জাগ্রত হূদয়ের স্পন্দন দেহকে ঘিরেই, চেতনায় যিনি খেলা করেন তাঁর সঙ্গে। কখনো একে বলি আত্মা, সত্তার গভীরে যিনি অবস্থান নিয়েছেন। আত্মাকে অহর্নিশ নিদ্রা থেকে জাগরণের দিকে উত্থানের প্রচেষ্টা জীবনপ্রবাহে আনে স্থিতি ও করে প্রগতিমুখী। মহাচীনে যাওয়ার আগে মহা প্রস্তুতি, অবগাহন করতে হয় লাওৎ জে, কনফিউসিয়াস [কংফুজি] ও চীনা মনীষীদের শত চিন্তার স্রোতে। মাও সে তুং তাঁর চিন্তাকে সম্মিলিত করেছিলেন কনফিউসিয়াসের সঙ্গে, যার নাম মাওচিন্তা। চীনাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কী? ‘এই ক্ষণটুকু, একে নির্মাণ করব সর্বোচ্চ নিষ্ঠা দিয়ে ’। বিজয় পতাকা হাতে নিতে হলে প্রয়োজন একটি মন্ত্রের। আমাদের ক্ষেত্রে হতে পারে এ মন্ত্রটি: প্রতি মুহূর্তে নিজেকে গড়ব আত্মার শক্তি নিয়ে।
শ্যামল বাংলা কতখানি এগিয়েছে জানার জন্য গ্রামে যাই। বদলেছে অনেকখানি, এগিয়েছে অনেকখানি। আর পিছিয়েছে ...। দারিদ্র্যের সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। খাওয়া-পরার দারিদ্র্য। আর মনের দারিদ্র্য? দিনকে দিন যে তা বেড়েই চলেছে। হিংসা-নিন্দা-পরশ্রীকাতরতা, ছোট কথা নিয়ে বড় বিরোধ, দলাদলি-আত্মম্ভরিতা-আত্মপ্রশংসা, নয়কে হয়, হয়কে নয়, ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মনের দারিদ্র্য ঘুচাব কেমন করে?
মাহফিলের বক্তব্য মন দিয়ে শুনছি। পল্লিগ্রামগুলো রাতের পর রাত সুবাক্যের বিন্যাসে আলোকিত দেখি। মসজিদে উপচে পড়ছে নামাজি। প্রতিফলন? ধর্মচর্চার মূলনীতিগুলোকে কি আমরা আঁকড়ে ধরতে পেরেছি? ধর্ম তো লোক দেখানোর জিনিস নয়, অন্তরেই হবে এর পরিচর্যা ও বিকাশ। অথচ অন্তর আছে ঘুমিয়ে। সেখানে নেই কোনো নির্দিষ্ট পথের ঠিকানা। কোথায় যাব জানি না। যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি।
ট্রেনে চাপলেই দৃষ্টিপাত দেয়ালের দিকে: ‘সত্তরজন বসিবেক’। কেউ কাগজ, কেউ বই, কেউ মোবাইল, কেউ কোক, ফান্টা, চা, কফি পানে সময়কে পার করে দিচ্ছেন ট্রেনকে পেছনে ফেলে। কেউ বা ঘুমিয়ে। ফজর, জোহরের অন্বেষণে, পূজায় নিবেদিত ছিলেন কি কেউ?
দৃষ্টি খুঁজে ফিরেছে সমান্তরালভাবে এমন মানুষের অন্বেষণের জন্য যে ক্ষুধার্তের ক্ষুধা বুঝেছে, এগিয়ে গেছে তার নিজের খাবার নিয়ে। বন্ধ জানালার ও-পাশে দাঁড়িয়ে অন্তহীন প্রতীক্ষায় অন্নহীন, বস্ত্রহীনেরা। বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী।
‘বাঙালিদের চোখে খেলা করেছে গরম ভাতের স্বপ্ন, সঙ্গে মুরুলী মাছের ঝোল’ [হিউয়েং সাংয়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত]। তাদের এ স্বপ্ন কবে রূপ নেবে? এই ট্রেনের গন্তব্যের শেষে তাদের যাত্রার সমাপ্তি হবে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা আসলে? তার অন্বেষণ কোথায় তাদের জীবনে? চীনারা ৩০ বছরে অনেক দূর এগিয়ে গেল। আমরা পারব না কেন?
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.