পুঁজিবাজার-বাংলাদেশে কি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ প্রয়োজন? by মামুন রশীদ

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বাজার মূলধন ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আনন্দেরই ব্যাপার। তবে কেন যেন আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমনকি বাজার বিশ্লেষকেরাও এটি নিয়ে আনন্দিত হতে পারছেন না। তাঁরা বরং আশঙ্কা বোধ করছেন। আশঙ্কা করছেন বড় ধরনের একটি বাজার সংশোধনের।


যাতে আবারও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিরাটভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। সর্বস্বান্ত হতে পারেন অনেকেই। বাংলাদেশের বাজার এমনিতেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী-নির্ভর বা তাঁদের বেশি আকর্ষণ করেছে এ বাজার। উপযুক্ত গবেষণার অভাবে বাজার হয়ে উঠেছে অনেকটা কতিপয় ব্যবসায়ী বা ব্রোকার-নিয়ন্ত্রিত। কিছু সংখ্যক টাইকুন বা ব্যবসায়ী বা ব্রোকার অনেকটা এককভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুরু হয়েছে অনেকটা ‘পাইয়ে দেওয়ার’ বাণিজ্যও। এই ‘পাইয়ে দেওয়ার বাণিজ্যেও’ অধুনা এসে যোগ হয়েছে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোও। আশা করা হয়েছিল, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে পুঁজিবাজারে গভীরতা সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু তারাও গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে বলে বাজারে জোর সমালোচনা রয়েছে। বরাবরের মতো এবারও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যেন অসহায়। ঘন ঘন রাজনৈতিক চাপেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। বিপরীতে বাজারে সুশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য, ফটকাবাজারি কমানোর জন্য অনেকের মধ্যেই আলোচিত হচ্ছে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যাপারটি।
আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা জাতীয়ভিত্তিক শেয়ারবাজারগুলো (এনএসই) কেন্দ্রীয় স্টক এক্সচেঞ্জ হিসেবে দিন দিন উন্নয়ন-উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে চলেছে। এসব কেন্দ্রীয় তথা জাতীয় স্টক এক্সচেঞ্জসমূহে বাজার মূলধন ও মোট লেনদেন উভয় দিক থেকেই দেশব্যাপী যেমন বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় কেনাবেচায় অংশগ্রহণের প্রবণতা জোরদার করে তুলছে, তেমনি পুঁজিবাজারের দক্ষতাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে অনুযায়ী আমাদের বাংলাদেশেও সম্ভবত একটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা জাতীয় ভিত্তিক শেয়ারবাজার গড়ে তোলার বিষয় ভেবে দেখার হয়তো সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, জাতীয়ভাবে এ ধরনের একটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) গড়ে তোলা হলে দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিকাশে অবদান রাখতে পারে।
সাধারণত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) ডিমিউচুয়ালাইজড মডেলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেখানে মালিকানা, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ও ট্রেডিং রাইট বা লেনদেনের অধিকার থাকে তিন ধরনের পৃথক মানুষের হাতে। এর ফলে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমে আসে। অর্থাৎ সবার স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বেশ সতর্ক থাকতে হয় দায়িত্ববানদের। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এনএসই থাকলে প্রাগ্রসর প্রযুক্তির টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশব্যাপী সব ধরনের সিকিউরিটজ তথা শেয়ারের লেনদেন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে সব বিনিয়োগকারীই শেয়ার কেনাবেচার সমান ও অবারিত সুযোগ পেতে পারেন।
পুঁজিবাজারের এই ধরনের মডেল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তথ্যের অসামঞ্জস্য দূর করে বা কমিয়ে আনে। বর্তমানে দেশের দুটি শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সদস্যপদ পাওয়াটা সত্যিকার অর্থেই খুব দুরূহ ব্যাপার। এটি যেন অনেকটা ‘সংরক্ষিত’ই হয়ে গেছে। আগ্রহীদের জন্য এই পদ লাভ করাটা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতরই হয়ে উঠছে। কারণ ডিএসই ও সিএসইতে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সদস্যপদ লেনদেন হয়ে থাকে। তদুপরি এটি মোটেই সহজপ্রাপ্য নয়। এই অবস্থায় দেশে একটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে না। বরং এটাকে সময়ের প্রয়োজন ও পুঁজিবাজারের ব্যবসায় নামতে আগ্রহীদের দাবি হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, দেশে এনএসই প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলে বিদ্যমান স্টক এক্সচেঞ্জ দুটির সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সদস্য-সীমাবদ্ধতা কিংবা প্রক্রিয়াগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেটি অতিক্রম করা যাবে। বদৌলতে শেয়ারবাজারের উন্নয়ন ও বিকাশের প্রক্রিয়া সন্দেহাতীতভাবে সম্প্রসারিত হবে। সেই সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এনএসইর ডিজাইনটাও এমনভাবে প্রণয়ন করা হবে যে সেখানে মালিকানার কাঠামোতে পর্যাপ্তসংখ্যক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি লেনদেনসহ সার্বিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। তবে, প্রস্তাবিত এই ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় কঠোর আইনি ও কার্যকর বিধি-বিধান নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা থাকে। প্রস্তাবিত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জটি (এনএসই) বাস্তবে আলোর মুখ দেখলে এটির পরিচালনায় বিশ্বমানের দক্ষতা রয়েছে, এমন ধরনের পেশাজীবীদের হাতেই দায়িত্বভার অর্পণ করতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন পুঁজিবাজারের মূলধনভিত্তি বাড়াতে অধিকসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ও সার্বিক কার্যক্ষম পরিচালনায় বৈশ্বিক মানের সর্বাধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে জোর দিতে হবে।
বিভিন্ন আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি যে একটি সুসমন্বিত আইনি কাঠামো-নির্ভর পর্যাপ্তসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণভিত্তিক ও বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) বাস্তবায়ন করা গেলে তা দেশে পুঁজিবাজারের দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। এতে দেশের যেকোনো প্রান্তেই হোক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাঁদের নিজ নিজ অফিস বা বাসায় বসেই শেয়ারের লেনদেন বা কেনাবেচা করতে পারবেন। আবার শেয়ারবাজারের লেনদেনসহ সার্বিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতার প্রবণতা টেকসই হবে। উপরন্তু এই এনএসইর মালিকানার পরিসর বিস্তৃত হলে দেশে পুঁজিবাজারের কর্মকাণ্ড যেমন বাড়বে, তেমনি এটি পরিচালনায় দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়োজিত করলে টেকসই সুশাসনও ত্বরান্বিত হবে। সব মিলিয়ে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির প্রবণতা জোরদার হবে।
আমরা জানি, দেশের বিদ্যমান পুঁজিবাজারে প্রায়ই বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থহানির ঘটনা সংঘটিত হয় বলে অভিযোগ ওঠে। আবার মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ চক্রের বিরুদ্ধে কারসাজিরও অভিযোগ পাওয়া যায়। সে জন্য প্রস্তাবিত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) সদস্য, ব্রোকার হাউস, সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ নির্বিশেষে সবার স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে জোর দিতে হবে। সব বিনিয়োগকারীর কাছে একই ধরনের তথ্য পৌঁছাতে হবে। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারীই যেন তথ্যের বিকৃতি কিংবা ঘাটতির কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া গুটিকয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যাতে গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম নিয়ে কারসাজি করতে না পারে এবং তেমন গর্হিত কাজ করলেও কঠিন শাস্তি পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ দেশের পুঁজিবাজারে এহেন জঘন্য প্রবণতা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করে আসছি, যা অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকেই বিভ্রান্ত করেছে এবং তাঁদের সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে। তা ছাড়া গুজব-কারসাজি শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরই বিভ্রান্ত ও সর্বস্বান্ত করে না, বরং এটি দেশের পুঁজিবাজারের দুর্নাম বাড়ায় ও বিপর্যয় ত্বরান্বিত করে। যেমনটা আমরা দেখেছি ১৯৯৬ সালে। সর্বোপরি, এ ধরনের অসুস্থ প্রবণতা অর্থনীতির জন্যও খুব খারাপ।
দেশে একটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়বে, যা তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও ব্যাপক হারে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে। এতে বিশ্বখ্যাত বহু বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউস কার্যক্রম চালাতে এ দেশে ছুটে আসবে। বদৌলতে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার যেমন দ্রুত বৈশ্বিক পর্যায়ের মান লাভ করবে, তেমনি আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক অর্জনও ত্বরান্বিত হবে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণের সুবাদে দেশের পুঁজিবাজার তথা ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে পি-নোটস, ইকুইটি ডেরিভেটিভস ও হাইব্রিড ইনভেস্টমেন্ট প্রভৃতি ধরনের নিত্যনতুন পণ্যও চালু হবে। এতে পুঁজিবাজারের দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটবে এবং মোট লেনদেনের পরিমাণ ব্যাপক হারে বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর পুঁজিবাজার তথা ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জগুলো (এনএসই) ইতিমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে।
দেশে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিকাশে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) হতে পারে অন্যতম সেরা উদ্যোগ। এটি হতে পারে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সমৃদ্ধির জন্য অধিকতর অবদান রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.