জন্মদিন-‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ by অমর সাহা

দেখতে দেখতে ৯০টি বছর কেটে গেল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ লিখেছিলেন আজ থেকে ৯০ বছর আগে। লিখেছিলেন কলকাতার তালতলা লেনের একটি ভাড়া বাড়িতে অবস্থানকালে, সেই ১৯২১-২২ সালের দিকে।


ওই সময় কবি নজরুল কলকাতার এই বাড়িতে ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে।
সুদীর্ঘকাল একেবারে আঁধারেই ছিল বিদ্রোহী কবিতা লেখার এই আঁতুড়ঘরটি। খোঁজ মিলছিল না। অবশেষে ইতিহাসবিদেরা মাত্র এক যুগ আগে খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়েছিলেন বিদ্রোহীর সেই আঁতুড়ঘরটিকে। সেই ১৯৯৯ সালে। বিদ্রোহী কবির জন্মশতবর্ষে। তারপর এই আঁতুড়ঘরটি ঠাঁই নিয়েছিল নতুন এক ইতিহাসের পাতায়। কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ যে ঘরে বসে লিখেছিলেন কবি, কবিভক্তরা সেই ঐতিহাসিক আঁতুড়ঘরটিকে সাজিয়েছিলেন। রাখা হয়েছিল চেয়ার, টেবিল আর কবির একটি প্রতিকৃতি। সেই ঐতিহাসিক বাড়ির কাছেই লাগানো হয়েছিল দুটি স্মৃতিফলক। বেশ ক বছর ধরে এই বাড়ির সামনেই কবিভক্তরা পালন করেছিলেন কবির জন্মজয়ন্তী। আজ সেসব ইতিহাস। সেই বাড়িটির মালিকানাস্বত্ব বদল হয়েছে। তবে ঠিক আছে সেই ঐতিহাসিক দ্বিতল বাড়িটি। কবি যখন এই বাড়িতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিলেন, তখন বাড়িটি ছিল একতলা।
এখন সেখানে কবির সেই ঐতিহাসিক কক্ষটি নেই। বাড়ির মালিক বদল হওয়ায় সবকিছু বদলে গেছে। বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছে সব স্মৃতিচিহ্ন। নেই ১৯৯৯ সালে রাখা চেয়ার, টেবিল আর কবির প্রতিকৃতি। নতুন মালিক এখন সংস্কার করেছেন এই স্মৃতিবাহী বাড়িটিকে। করেছেন আবাসিক গৃহ। মুছে দিয়েছেন কবির সেই স্মৃতিবাহী কক্ষটি।
কলকাতার কেন্দ্রস্থলে তালতলা লেন। ধর্মতলা আর শিয়ালদহের মাঝামাঝি এর অবস্থান। এস এন ব্যানার্জি রোডের একটি লেন এটি। এই লেনেরই ৩/৪সি বাড়িটিতেই থেকেছেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। ১৯৯৯ সালে কবির জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে ইতিহাসবিদেরা খুঁজে বের করেন এই ঐতিহাসিক বাড়িটি।
১৯৯৯ সালে যখন এই বাড়ি ঘিরে অনুষ্ঠান চলছিল, তখন এই বাড়ির মালিক ছিলেন গোবিন্দ লাল দে। বাড়ির নাম ছিল ‘রাজেন্দ্র কুটির’। এখন এই বাড়ির নতুন মালিক সীমা সাহা।
এই এলাকার সাবেক বিধায়ক, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী অজিত পাণ্ডে প্রথম আলোকে জানান, ১৯৯৯ সালে তিনি ছিলেন এই এলাকার বিধায়ক। ১৯৯৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারকাজ চালাতে গিয়ে তিনি সন্ধান পান বাড়িটির। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা তাঁকে জানান, এই তালতলার বাড়িতে বসেই নজরুল লিখেছিলেন ‘বিদ্রোহী’। এর পরই অজিত পাণ্ডে বাড়িটিকে সংরক্ষণ করে এখানে নজরুলকে নিয়ে একটি সংগ্রহশালা বানানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাতে পুরোপুরি সায় দেননি ওই বাড়ির মালিক। তবে বারান্দার যে কক্ষে নজরুল অবস্থান করেছিলেন এবং বিদ্রোহী কবিতা লিখেছিলেন, সেই কক্ষটি তিনি ছেড়ে দেন। এর পরই এখানে টেবিল, চেয়ার ও নজরুলের ছবি বসিয়ে তৈরি করা হয় নজরুল স্মৃতিকক্ষ। ১৯৯৯ সালের ২৪ এপ্রিল এই বাড়ির সামনে একটি ফলকও উন্মোচন করা হয়। আর এসব করার উদ্যোগ নেয় তালতলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি। সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অজিত পাণ্ডে। ওই ফলকে লেখা হয়, ‘চির যৌবনের প্রতীক কবি নজরুল ইসলাম তাঁর জঙ্গম জীবনের কিছুকাল (১৯২১-২২) অতিবাহিত করেন এই প্রাঙ্গণের ভিতর ৩/৪সি, তালতলা লেনে। এখানেই রচিত হয় তাঁর বাঁধনহারা কবিমনের প্রথম উদ্দাম উচ্ছ্বাস “বিদ্রোহী” কবিতা। তালতলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ২৪শে এপ্রিল, ১৯৯৯।’ ফলক উন্মোচন করেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায়। একই সময় তালতলা লেনের প্রবেশমুখে আরও একটি ফলক উন্মোচন করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
অজিত পাণ্ডে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি এই বাড়িটিকে রক্ষা করতে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। বারবার চেয়েছি এই বাড়িটিকে “ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে এখানে সংরক্ষণ করা হোক নজরুলের স্মৃতি। কিন্তু পারলাম না। এই আফসোসই আজ আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।’
আজ এলাকার মানুষজন চান নজরুলের স্মৃতিবাহী এই বাড়িটিকে ঐতিহ্য বা হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে রক্ষা করা হোক নজরুল স্মৃতিকক্ষকে। প্রতিষ্ঠা করা হোক এখানে নজরুল স্মৃতিভবন। তালতলা লেনের নামও পরিবর্তন করে রাখা হোক নজরুল স্মৃতি লেন।
অমর সাহা
কলকাতা

No comments

Powered by Blogger.