নারীমুক্তির সংগ্রাম চলছেই by লীনা চক্রবর্তী

'জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা'_বিদ্রোহী কবির এই আহ্বান, এই আকুতি সমাজে এখনো সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু কেন? দেশের জনসমাজের অর্ধাংশ নারী। শতবর্ষ আগে ক্ষণজন্মা নারী বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, দেশের অর্ধাংশ নারীসমাজকে পঙ্গু করে, ঘরে শেকল দিয়ে রেখে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়।


নারীকে শিক্ষার অধিকার দেওয়া হোক, পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করতে দেওয়া হোক; তবেই সমাজ এগোবে, দেশ এগোবে। শতবর্ষেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শুধু এই বাংলাদেশে কেন, পৃথিবীজুড়ে শত শত বছর নয়, হাজার বছর ধরে নারীরা নানা শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার। নানা ধরনের নারী নির্যাতন, ফতোয়াবাজি, ধর্ষণ, তালাক, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, নারী পাচার ও যৌন নিপীড়ন চলছেই। এর যেন শেষ নেই। নতুন এক নামকরণ করা হয়েছে 'ইভ টিজিং'। যেন অপ্রাপ্তবয়স্ক, কিশোরী, তরুণী, যুবতী মেয়েগুলো বিশ্ববখাটে, ড্রাগ অ্যাডিক্টেড, বেকার মাস্তান, গুণ্ডাপাণ্ডাগুলোকে অনবরত প্ররোচিত ও প্রলুব্ধ করছে, আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, আহ্বান করছে পাশবিক নির্যাতন করে তাদের খুন করার জন্য। যদি খুন না হয়, তবে অপমানে-অসম্মানে আত্মহত্যা করার জন্য। সচেতন নারীসমাজ ধিক্কার জানায় ওই শব্দগুচ্ছের আবিষ্কারক এবং পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় যারা অনবরত প্রচার করে চলেছে তাদের। যৌন নির্যাতন, পাশবিক নির্যাতন যার যা নাম প্রাপ্য তাকে সেই নামেই বলা প্রয়োজন, নচেৎ তার অন্যায়ের ভর বা ওজন কমে যায়, তার অন্যায়কে লঘুভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়, যা সজ্ঞানে ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই করা হচ্ছে। যেখানে অর্থবিত্তের প্রাচুর্য, সেখানে নারী আরাম-আয়েশে অভ্যস্ত এবং সামাজিকতার চাপে অপমান-অসম্মানের মধ্যেই জীবন কাটিয়ে দেয়। আর বিত্তহীন সংসার নারীকে সমাজ-সংসারের দায়িত্ব, অর্থাৎ সন্তানের বোঝা চাপিয়ে পথে বের করে দেয়। গৃহকর্মে নিযুক্ত যে নারী, সে ক্রীতদাসের জীবন বয়ে বেড়ায়। মাটি কাটা বা অন্যান্য নির্মাণকর্মে নিযুক্ত নারী পুরুষের সঙ্গে সম-শ্রমঘণ্টা ও একই কাজ করে দিনান্তে মজুরি পায় অর্ধাংশ অথবা দুই-তৃতীয়াংশ। কারণ তার কোনো সংগঠন নেই। শ্রমজীবী নারীর কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শেষ নেই।
এটা ২০১১ সাল। এ বছর বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পালিত হলো। অধিকারবঞ্চিত নারীসমাজের হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের উত্তরাধিকারের পথ বেয়ে ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুচ কারখানার নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমের সময় দৈনিক ১৬ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ১০ ঘণ্টা করা এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নের দাবিতে যে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার শিকাগোতে নারী শ্রমিকরা রক্তক্ষয়ী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ভোটাধিকার আন্দোলনকে তার লক্ষ্যে পেঁৗছে দেয়। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জাটকিনের প্রস্তাবে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯১০ সালের ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর পথ ধরেই ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আমাদের দেশে শতবর্ষের নারী আন্দোলনের পরেও সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নারী-পুরুষের সমআইন, অর্থাৎ ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু হয়নি। কর্মক্ষেত্রে মজুরিবৈষম্য দূর হয়নি। সিডও দলিলের পূর্ণ অনুমোদন বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৯৭ সালে ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়িত করা যায়নি। হিন্দু বিবাহ আইন সংস্কার ও রেজিস্ট্রেশন চালু করা হয়নি। নারীর জন্য জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন এক-তৃতীয়াংশ করে সরাসরি নির্বাচনের দাবি বহু দিনের। কর্মক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে সরকার।
সহযোদ্ধা বন্ধু হিসেবে শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণ জাতিগত নির্যাতনে পর্যুদস্ত কোটি মানুষকে তাই আজ হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে জয় ছিনিয়ে আনার জন্য। সব শোষিত, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির এ লড়াই শুধু নারীমুক্তির আন্দোলন নয়_গণতন্ত্র, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের পথ বেয়েই নারী মুক্তির সংগ্রামকেও এগিয়ে নিতে হবে। সত্যিকার সম-অধিকার নারীকে দিতে পারে একমাত্র সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদ।
এই ২০১১ সালে বসে ভাবতে বড় অবাক লাগে, নারী যে নারী সে কি তার কোনো পাপের ফল? আর পুরুষ যে পুরুষ সে কি তার কোনো পুণ্যের ফল, তা তো নয়। বিজ্ঞান আমাদের জানিয়েছে, কোটি কোটি বছর আগে যখন প্রাণের আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীতে, তখন সে ছিল শেওলা জাতীয় এককোষী প্রাণী। কোটি বছরে প্রতীয়মান হয় যে তাতে প্রাণের অগ্রগতি পিছিয়ে যাচ্ছে, বারবার ধেয়ে আসছে মৃত্যু। তাই প্রকৃতি নিজের খেয়ালে, নিজের অভিজ্ঞতায় এককোষী প্রাণীকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে বংশবিস্তারের দায়িত্বটাকে নারী-পুরুষ ভিন্ন সৃষ্টি করে তাদের ওপর ন্যস্ত করে দ্রুতগতি সঞ্চার করে জীবনের অগ্রযাত্রা, মৃত্যু পিছু হটে। আমরা এও জানি, নারীর দাসত্ব প্রকৃতির আদি ব্যবস্থা নয়। নারীর আগুন আবিষ্কার, কৃষিকর্ম আবিষ্কার_সঙ্গে গৃহপালিত পশুর কারণে শস্যসম্পদ সঞ্চয় হতে আরম্ভ করে এবং ধীরে ধীরে পরিবারের উদ্ভব ঘটে ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তিত হয়ে নারীকে গৃহকোণে আবদ্ধ করে। এতে নারীর অপরাধ কোথায় যে হাজার হাজার বছর ধরে তাকে এ দায় বইতে হচ্ছে? এবার নারীরা মুক্তি চায়, তাদের মুক্তি দিতে হবে, নারীকে মুক্ত হতে হবে এবং নারী-পুরুষ মিলিতভাবে সংসারের, সমাজের, প্রকৃতির দায় সমভাবে বহন করে মানব মুক্তির সনদ সাম্যবাদ গড়ে তুলতে হবে। মাভৈ।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য

No comments

Powered by Blogger.