নদী দখল-এমন আমলাদের লইয়া দেশ কী করিবে! by এ কে এম জাকারিয়া

দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গিয়ে হান নদীতে এক সন্ধ্যা কাটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানী সিউলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে এই নদী। রাষ্ট্রীয় সফর; অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে প্রধানমন্ত্রীর সারা দিন। এরপর ঘণ্টা খানেকের এ ধরনের নৌবিহার নিশ্চয়ই অনেক স্বস্তির। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে তা উপভোগ করেছেন।


কোনো দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা যখন অন্য কোনো দেশে যান, তখন সফরসূচিতে সাধারণত এ ধরনের কিছু কর্মসূচি থাকে। কিন্তু হান নদীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই নৌবিহারের আলাদা গুরুত্ব আছে। কোরিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই নদীটি একসময় খুবই দূষিত হয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে সিউলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অংশে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর এখন যা দশা, অনেকটা সে রকম। সেই নদীটি এখন দূষণমুক্ত। নৌবিহারে সিউল মেট্রোপলিটন সরকারের মেয়র প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। একসময়ের দূষিত এই নদীর পানি কীভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে, কীভাবে নদীটিকে আগের প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন মেয়র। গণমাধ্যমে এসব খবর এসেছে। প্রধানমন্ত্রী যে অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছেন, তা আমাদের কাজে লাগবে—এমন আশা আমাদের রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দক্ষিণ কোরিয়া সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি চুক্তি ও দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নদীর পরিবেশ পুনরুদ্ধারে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার জন্য। এর ফলও নিশ্চয়ই সামনে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করতে বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগের কথা আমরা জেনেছি। তবে দখল বা দূষণ—কোনোটাই থেমে নেই। দূষিত নদীর পানি পরিষ্কার করার কারিগরি সহযোগিতা হয়তো দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পাওয়া যাবে, কিন্তু দখলদারদের মোকাবিলার ‘কারিগরি’ সহযোগিতা তো তাদের কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ নেই। আশাবাদী হতে গিয়েও তাই খুব ভরসা পাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী মেঘনা দখলের খবর পত্রিকায় দেখে সাড়া দিয়েছেন, দখলমুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে নিজের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে দখলের খবর বের হবে, তারপর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে কাজ হবে—এটাই যদি বাস্তবতা হয়, তবে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কই? বাংলাদেশ নদীর দেশ, কোথায় কে কোন নদীর কোন অংশ দখল করছে, তার খবর কে রাখবে? যাঁদের রাখার কথা তাঁরা যে রাখছেন না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। মেঘনায় নদী ভরাটের কাজ লুকিয়ে হয়নি, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা যাঁদের, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের আগে কিছুই করতে পারেননি বা করেননি।
সিউলের হান নদীতে প্রধানমন্ত্রীর নৌবিহারের খবর যেদিন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (১৮ মে), সেদিনই হাইকোর্ট বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান ও একজন উপপরিচালকসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে তাঁরা ঢাকার চারপাশের চারটি নদী দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন না; বরং তা করতে বাধা দিচ্ছেন। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। যে চারজনের বিরুদ্ধে ওই আদেশ জারি হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দুজন ব্যবসায়ী; যাঁদের স্থাপনা রয়েছে নদীতে। তাঁরা তাঁদের ব্যবসায়িক বিবেচনায় স্থাপনাগুলো রাখার শেষ চেষ্টা করবেন—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ও উপপরিচালক (বন্দর ও ট্রাফিক, নারায়ণগঞ্জ) কেন এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন, সেটাই বিস্ময়কর। যাঁদের কাজ আদালতের নির্দেশ মেনে দ্রুত নদী অবৈধ দখলমুক্ত করা, তাঁরাই কার্যত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। নিজ দলের লোকজনকে না হয় প্রধানমন্ত্রী সামলাবেন, নদী দখলমুক্ত করার নির্দেশও দেবেন, কিন্তু এ ধরনের কর্মকর্তা দিয়ে তিনি কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবেন! এমন আমলাদের লইয়া দেশ কী করিবে!
বিআইডব্লিউটিএর দুই কর্মকর্তা কারণ দর্শানের জন্য দুই সপ্তাহের সময় পেয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জবাব দেবেন ও আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ এই দুজনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনে আদালতে আবেদন করেছে, ঢাকার নাগরিক হিসেবে তা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত হোক, তা ঢাকার নাগরিক মহলের একটি দীর্ঘদিনের চাওয়া। গত বছরের ২৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে এই চাওয়া আইনগত ভিত্তি পায়। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চ ‘নদীগুলো থেকে ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব ধরনের আবর্জনা ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ’ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। কিন্তু নদীতে স্থাপনা আছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আপিল করায় রায় বাস্তবায়ন অনেক দিন ঝুলে থাকে। সেই রায়ের প্রায় বছরখানেক পর ৩ মে আপিল বিভাগ ঢাকার চারপাশের চার নদীর ওপর গড়ে ওঠা সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। আপিল বিভাগের রায়ের পর প্রথম আলোর সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল—‘এখন আর নদীর এলাকা নদীকে ফিরিয়ে দিতে কোনো বাধা বা ওজর-আপত্তি ধোপে টিকবে না।’ কতিপয় আমলার কারণে আমাদের এই আশাবাদ শুরুতেই হোঁচট খেল।
আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নদীর চারপাশ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল, একই সঙ্গে আদালত প্রতি তিন মাস পর পর অগ্রগতি জানাতে সরকারকে নির্দেশ দেন। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক সে অনুযায়ী উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আদেশও দেন; কিন্তু বাদ সেধেছেন বিআইডব্লিউটিএর দুই কর্মকর্তা। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও উপপরিচালক(বন্দর ও ট্রাফিক, নারায়ণগঞ্জ) তাঁদের মন্ত্রণালয়ে আলাদা আলাদা চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে কয়েকটি জেটি ভাঙা যাবে না; কারণ বিআইডব্লিউটিএ তাদের আইনগতভাবে অনুমতি দিয়েছে। রিট আবেদনকারীর অভিযোগ, উচ্চ আদালতের রায়ের পর এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএর এই দুই কর্মকর্তা উচ্ছেদকাজ বাধাগ্রস্ত করছেন। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পর এই দুই কর্মকর্তা কেন আবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখলেন, এ প্রশ্নটি বিচার-বিবেচনা করা জরুরি। আপিল বিভাগের রায়ের পর তাঁদের তো ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল রায় বাস্তবায়নের কাজে। বিষয়টি জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেটা না করে এই দুই কর্মকর্তা কার্যত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জেটি কীভাবে রক্ষা করা যাবে, সে কাজে নেমেছেন। বিআইডব্লিউটিএ ওই দুটি প্রতিষ্ঠানকে জেটি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশের পর ওই অনুমতির আর বৈধতা থাকার কথা নয়। কারণ, গত বছরের ২৫ জুন হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনায় রাজধানীর চারপাশের চার নদী—বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা থেকে জনগণের ব্যবহারের জন্য সরকার-স্থাপিত স্থাপনা ছাড়া সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালতের রুল জারির পর বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বিবিসি রেডিওকে বলেছেন, তিনি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন আদালতের ‘অধিকতর নির্দেশনা’ পাওয়ার জন্য। তিনি চিঠি লিখেছেন তাঁর মন্ত্রণালয়ে, সেখান থেকে তা যাবে আইন মন্ত্রণালয়ে, আইন মন্ত্রণালয় এর ওপর সারসংক্ষেপ তৈরি করবে; এরপর নাকি আদালতের ‘অধিকতর নির্দেশনা’ পাওয়া যাবে এবং তিনি তার প্রতীক্ষা করছেন। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আদালতের ‘অধিকতর নির্দেশনা’ চাইছেন না সময়ক্ষেপণ করতে চাইছেন—একজন নাগরিক হিসেবে সে প্রশ্ন আমরা তুলতে পারি। কারণ, যে দুজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একই সঙ্গে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য স্থাপিত জেটিগুলো রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আবেদন করেছেন। এই আবেদনের ফলাফল না জানা পর্যন্ত যাতে জেটিগুলো ভেঙে ফেলা না হয়, সে জন্য কিছু সময়ের দরকার। আদালতের ‘অধিকতর নির্দেশনা’র নামে এই সময়ক্ষেপণের প্রক্রিয়া কি সে কারণেই?
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের জাস্টিনিয়ান কোড, যার ওপর ভিত্তি করে সারা দুনিয়ার উচ্চ আদালত মেনে নিয়েছে যে বায়ু, পানিপ্রবাহ ও সমুদ্র সর্বজনীন সম্পদ। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে তা বিক্রি বা ইজারাও দিতে পারে না। কখনো দেওয়া হলে তা অবৈধ বলেই গণ্য হবে। পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিন বা প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার নীতি ও মূলমন্ত্র অভিন্ন। বাতাস, প্রবাহিত জলধারা, সমুদ্র ও সমুদ্রতীর জনগণের সাধারণ সম্পত্তি। সরকার কারও কাছে তা বিক্রি করতে পারে না। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো থেকে জনগণের ব্যবহারের জন্য সরকারের বানানো স্থাপনা ছাড়া সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের নির্দেশনার মধ্যে এই নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে। এখন আমলাদের কেউ যদি তা মানতে না চান, তবে সরকার কাদের ওপর ভরসা করে জনগণের অধিকারগুলো রক্ষার কাজ করবে?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.