চরাচর-মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ by সাইফুল ইসলাম খান

একাত্তরের ১ মার্চ আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলে বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কারফিউ পালন করতে গিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে শতাধিক লোক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। সপ্তাহব্যাপী গণবিক্ষোভ শেষে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর খুব দ্রুত বাংলাদেশের দৃশ্যপট বদলাতে থাকে।


২০০ বছরের বেশি সময় পরাধীন বাঙালি জাতির মনে স্বাধীনতার বাসনা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। দেশের প্রতিটি প্রান্তের মতো সে আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে জয়দেবপুরে। এখানেও গঠিত হয় সর্বদলীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ। একদিকে তীব্র হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কৌশলে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে থাকে। সরকারের এ কৌশল আঁচ করতে পেরে জয়দেবপুরের দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা অফিসাররা তা স্থানীয় নেতাদের অবহিত করেন। স্থানীয় নেতারা পাকিস্তানি সৈন্যদের এ চেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে (বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) ছিল দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। এ রেজিমেন্টে ২৫-৩০ জন পাঞ্জাবি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি অফিসার ও সৈনিক। রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান খান এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর কে এম সফিউল্লাহ (মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্সের অধিনায়ক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান)। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজের আবরার শতাধিক পাকিস্তানি অফিসার এবং এক কম্পানি সৈন্য নিয়ে পাঁচটি ভ্যানে করে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা হন। ১৯ মার্চ দুপুরে জাহানজের আবরার দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন। মুহূর্তেই এ সংবাদ জয়দেবপুরসহ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে হাজার হাজার জয়দেবপুরবাসী শহরে জমায়েত হয়। তারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে জয়দেবপুর ও ঢাকার মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটিতে ব্যারিকেড তৈরি করে। এদিকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজের আবরার বাঙালিদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাঙালি সৈন্যদেরসহ ঢাকা ফিরে যাওয়ার সময় জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিংয়ে জনতার ব্যারিকেডের সম্মুখীন হন। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বদমেজাজি জাহানজের আবরার তখন গুলি করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা জনগণের ওপর গুলি করতে অস্বীকার করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করলে উত্তেজিত জনতা সৈন্যদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী কাজী আজিমউদ্দিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কাজী আজিমউদ্দিনসহ আরো দুজন তাঁদের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে গুলিবর্ষণ করেন। হুরমত উল্লাহ নামের অসম সাহসী এক যুবক এক পাঞ্জাবি সৈন্যকে ঝাপটে ধরে রাইফেল ছিনিয়ে নেন। তখন আরেক পাঞ্জাবি সৈন্যের গুলিতে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে নিয়ামত, মনু খলিফা, কানু মিয়াসহ মোট ২০ জন শহীদ হন। আহত হন অনেকে। অবশেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জাহানজের আবরার ব্যারিকেড সরিয়ে ঢাকা ফিরে যেতে সক্ষম হন। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের এ প্রতিরোধই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে দেশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। তাই সারা দেশে স্লোগান উঠেছিল_'জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।'
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.