ফেসবুক-অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? by জাকারিয়া স্বপন

সকালে নাশতা সেরে কেবল চায়ে চুমুক দিয়েছি। তখনই একটা এসএমএস এল, ঢাকা থেকে। এক বন্ধু লিখেছে, ‘সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে। তোর ভক্তকুলের জন্য আমার মায়াই লাগছে।’বাংলাদেশ সরকার কেন ফেসবুক বন্ধ করেছে, সেটা এসএমএসে সে লেখেনি।


কিন্তু আমার আই-ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম, এর আসল কারণ কী। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে লগইন করে স্ট্যাটাস আপডেট করলাম, ‘বাংলাদেশ কি ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে?’
মাত্র পাঁচ মিনিটের ভেতর আমি পুরো চিত্রটি পেয়ে যাই। প্রথম আলোর রিপোর্টে কী লিখেছে, বাংলাদেশের টেলিভিশনের খবরে কী বলেছে, ঢাকায় কী নিয়ে গুজব হচ্ছে, সবকিছু। ফেসবুকে পোস্ট করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি কোলাজ ছবি নিয়ে কয়েক দিন ধরে আবহাওয়া একটু গরম হচ্ছিল। সেই অজুহাতে আজ দুপুরে ঢাকায় র‌্যাবের সদস্যরা একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর সন্ধ্যায় পুরো ফেসবুকই বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও এর সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতির একটা সুর লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু সেটা যে শুধুই লোক দেখানো তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। পুরো ফেসবুকজুড়ে মুহূর্তেই এর প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের জন্য নিন্দা জানাতে থাকে। আমি যখন লিখছি, তখনো চলছে সেই নিন্দা-পর্ব। এটা চলবে আরও বেশ কিছুদিন।
এই একই সময়ে বাংলাদেশের জন্য একটি গর্ব করার মতো বিষয় ঘটেছে। সেটা হলো, আমাদের একটি ছেলে মুসা ইব্রাহীম এই প্রথমবারের মতো এভারেস্ট জয় করেছে। বাংলাদেশ থেকে এভারেস্টের দূরত্ব খুব বেশি নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভারেস্ট বিজয় করলেও বাংলাদেশ থেকে এর আগে কাজটি কেউ করেনি। এর অর্থ খুব সহজ। আমাদের সেই সাহস ছিল না। কিন্তু মুসার এই এভারেস্ট বিজয় আমাদের জন্য একটি ভিন্ন সংবাদ বহন করে। আমাদের সাহস বেড়েছে। আমরা যে এভারেস্ট জয় করতে পারি, এই সাহসটুকু আমাদের নতুন প্রজন্মের ভেতর তৈরি হয়েছে। আমি এটাকে মুসার একার বিজয় দেখি না; এটা এই সময়ের বিজয়। আমরা যেই কাজ শত বছরেও করতে পারিনি, তরুণ প্রজন্ম সেগুলোতে হাত দিয়েছে। পাশাপাশি মুসার এভারেস্টের দিকে রওনা দেওয়া থেকে শুরু করে, যখন চূড়ায় পৌঁছেছে, তারপর আবার নেমে এসেছে—তার প্রতিটি খবর এবং ছবি আমরা পেয়েছি ফেসবুক থেকে (মুসা নিজেও ফেসবুক ব্যবহার করেন)। বাংলাদেশের পতাকায় আর মুসার ছবিতে ভরে গেছে ফেসবুক।
কিছু দিন আগে জীবন বাঁচানোর জন্য তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিল এক বন্ধুর। তাঁকে রক্ত দেওয়ার জন্য ২৩ জন লোক লাইনে ছিল। রক্তটা চাওয়া হয়েছিল ফেসবুকেই।
এটাই হলো, ফেসবুকের ক্ষমতা। ইন্টারনেট-বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, বর্তমান সময়ে একটি খবর পুরো পৃথিবীতে প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে মাত্র ছয় সেকেন্ড। সময় যেভাবে পাল্টাচ্ছে, তাতে কিছু দিনের ভেতর একটি খবর সেকেন্ডে ছয়বার প্রদক্ষিণ করবে পৃথিবী। সামাজিক যোগাযোগ(সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং) এখন এতই ক্ষমতাশালী হয়ে পড়েছে যে বিশ্বের ৫০টির বেশি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ওপর গবেষণা চলছে এবং পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে। গণতন্ত্র, তৃণমূল মানুষের ক্ষমতায়ন, স্বচ্ছতা, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, চাঁদা তুলে সাহায্য করা, রাজনৈতিক প্রচারণা, মুক্তচিন্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় জড়িয়ে গেছে সামাজিক গণমাধ্যমের সঙ্গে। এটা বুঝতে না পারার অর্থ হচ্ছে মূর্খতা। আর যাঁরা এটাকে বন্ধ করার কথা ভাবেন, তাঁদেরকে কুপমন্ডুক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। যাঁরা এটাকে শুধু একটা আড্ডার জায়গা ভাবেন, কিংবা মনে করেন তরুণদের সময় কাটানোর একটা বাজে জায়গা, তাঁদের চিন্তার মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এই পৃথিবীতে কী সামাজিক পরিবর্তন ঘটে গেছে এবং যাচ্ছে।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই কিছু দিনের জন্য ইউটিউব বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং তখনো তাঁরা চরম ভর্ৎসনার মুখোমুখি হয়েছিল। আজকে এই কাজটি করে, সরকার তার নিজের গালে নিজেই আরেকটি চড় বসাল। আমি লিখতে লিখতেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর শিরোনাম দেখছিলাম। বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, এপি, রয়টার্স, ইয়াহু, গুগল, ডেইলি টাইমস, এনডিটিভি, টেলিগ্রাফ, পিটিআই ইত্যাদি। সবার শিরোনাম হলো, বাংলাদেশ ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মক শিরোনামটি হলো, ‘বাংলাদেশ পাকিন্তানকে অনুসরণ করল।’
এই কি একটি স্বাধীন দেশের অর্জন? যেসব দেশ ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়, সারা বিশ্বে তাদের দেখা হয় সবচেয়ে খারাপ জাতি হিসেবে। পাকিস্তান যখন ফেসবুক এবং ইউটিউব বন্ধ করল, তখন এখানকার মানুষকে দেখেছি, মুখ বাঁকিয়ে বলেছে, ‘ও, পাকিস্তান!’ এর অর্থ হলো, পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশ তো এটাই করবে। সেই দলে কি আমরাও যোগ দেব?
আজকে যখন মুসা এভারেস্ট জয় করল, তাতে আমরা যত খুশি হয়েছি, সেটা কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেছে? মোটেও না। আমি তখনো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খেয়াল করেছি। কোনো শিরোনাম ছিল না। কিন্তু একটি ছেলে প্রধানমন্ত্রীর ছবির কোলাজ করে পোস্ট করায় ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়াতে তার প্রভাব কত বিশাল কেউ কি একবার ভেবে দেখেছেন? আমাদের হাজারও ভালো অর্জন খেয়ে ফেলে একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, বাংলাদেশের এই ঘটনাটি আগামী কয়েক দশকেও ঘুচাতে পারবে না। এই একটি ঘটনাই আমাদের টেনে পাকিস্তানের কাতারে শামিল করেছে। এরপর থেকে যখনই কোনো খারাপ উদাহরণের প্রয়োজন হবে, অন্য মৌলবাদী উগ্র দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নামটিও চলে আসবে। এটাই কি আমাদের ১৬ কোটি মানুষের প্রাপ্য? বাংলাদেশ কি এই গ্রহের বিচ্ছিন্ন কোনো দেশ? আমাদের ছেলেমেয়েরা কি বিদেশে যাবে না? আমাদের সাংবাদিকেরা, শ্রমিকেরা, পেশাজীবীরা যখনই বিদেশের মাটিতে পা রাখবেন, কিংবা যাঁরা এখন প্রবাসে আছেন, এ ঘটনাটির জন্য তাঁদের মাশুল দিতেই হবে। কর্মক্ষেত্রে, খেলার মাঠে, কফির আড্ডায় অন্যরা তাঁদের দিকে ভিন্নভাবে তাকাবেই এবং সেই তাকানোটা মোটেও সম্মানের নয়, শ্রদ্ধার নয়। সেই চাহনি করুণার, ভিক্ষার, দয়ার।
জাতি হিসেবে আমাদের কি এটাই প্রাপ্য ছিল? গুটিকয়েক অবিবেচক মানুষের জন্য পুরো জাতির ওপর এই কলঙ্ক লেপন কি অপরাধ নয়? প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃত করে একটি ছেলে যে অপরাধ করেছে, তার চেয়ে বড় অপরাধ করেছেন তাঁরা, যাঁরা ফেসবুক বন্ধ করে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে পৃথিবীর সামনে ছোট করেছেন। পুরো দেশকে এভাবে লজ্জায় ফেলে দিয়ে কারও সম্মান বাঁচানো যায় না। এর প্রভাব আগামী নির্বাচনেও যে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সিলিকন ভ্যালি, যুক্তরাষ্ট্র
জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।
zakariaswapan@hotmail.com
ফেসবুক: http://www.facebook.com/zakaria.swapan

No comments

Powered by Blogger.