প্রতিক্রিয়া-‘বিশ্ব-বিদ্যা লয়’ নয়, কিছুটা হলেও ‘বিশ্ব-বিদ্যা’র চর্চা হয় by সৌরভ সিকদার

২৩ মে প্রথম আলোয় গবেষক গোলাম মুরশিদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে ‘বিশ্ব-বিদ্যা লয়’ লেখাটি পড়ার পর আমাদের উচ্চশিক্ষার বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। প্রথমেই বলে নিই, লেখক গোলাম মুরশিদের কিছু বিষয়ের সঙ্গে আমি একমত নই।


বিশেষ করে ছাত্রদের প্রসঙ্গে, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শুধু রাজনীতি, গুন্ডামি, টেন্ডারবাজিই করে না; তারা লেখপড়াও করে, বিতর্ক চর্চা করে, রক্ত সংগ্রহ করে, গবেষণাও করে। এ দেশের ভবিষ্যতের শিক্ষিত সুনাগরিক গড়ে তোলার যে একটি মাত্র কারখানা আছে তা যত জীর্ণই হোক, সে তো আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের জাতীয় রাজনীতির নষ্ট সংস্কৃতির দিকে যদি দৃষ্টি দিই, তাহলে কী দেখতে পাই? নিশ্চয় আমরা স্বপ্নময় হয়ে উঠতে পারি না। জাতীয় রাজনীতির এই নষ্ট সংস্কৃতির প্রভাব যে ছাত্ররাজনীতিতে পড়বে, এ আর অবাক কী! গোলাম মুরশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি নষ্ট হওয়ার পেছনে শিক্ষকরাজনীতিকেও দায়ী করেছেন—এ মন্তব্যটি যথার্থ নয়। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছেন নিজেদের স্বার্থে, উপাচার্য থেকে শুরু করে পিএসসির সদস্য প্রভৃতি পদ লাভের বাসনায়। দেশে যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে সে দলের সমর্থকেরা নানা পদ-বর পেয়ে থাকেন রাষ্ট্রের নানা উচ্চপদে, যোগ্যতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাপকাঠি হয় না, এমনকি পূর্ববর্তী উপাচার্য যত যোগ্যতাসম্পন্ন ‘ভালো’ হন না কেন, তাঁকে বিদায় হতে হয় সরকারবদলের সঙ্গে সঙ্গে। কই, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে তো এমনটি হয় না। সেখানে কংগ্রেস বিদায় নিয়ে বিজেপি এলেও উপাচার্য পদে দলীয় লোক নয়, যোগ্য লোক খোঁজে। যে দিন আমাদের দেশে সুস্থ রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হবে, সে দিন শিক্ষকদের সাদা-নীল সব এমনিতেই ধূসর হয়ে যাবে। তখন দলীয় ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ হবে না, ৫২ জন প্রথম শ্রেণী পাবে না, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হবে না, পরীক্ষার খাতা দেখতে বিলম্ব হবে না, কেননা অপরাধ করে দলীয় বিবেচনায় তখন পার পাওয়া যাবে না।
লেখক গোলাম মুরশিদ শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজে (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান) উৎসাহের কথা বলেছেন। সে তো সত্য, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষক খণ্ডকালীন হিসেবে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করেন, এখানে দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা (পরীক্ষায় ভালো ফল করে যোগদানের পর) যে বেতন পান, প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই স্বল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে তিনি যদি খণ্ডকালীন হিসেবে কোথাও কাজ করেন তাতে দোষের কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, এতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর উপযোগী যোগ্য শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে? ঘুরেফিরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাত বাড়াতে হবে। খণ্ডকালীন চাকরি করা দোষের নয়, যদি আমরা আমাদের মূল কর্মস্থলে ঠিকমতো সেবা দিয়ে যাই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে কিছু বলতে গেলে পৃথকভাবে লিখতে হবে, এটি ভবিষ্যতের জন্য থাক।

দুই.
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ প্রভৃতি বিষয় নানাভাবে আলোচিত হয়েছিল। (২০০৮ সালের ২৬ তারিখে প্রথম আলো এবং ২৯ এপ্রিল ডেইলি স্টার-এ এ বিষয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ লেখাও ছাপা হয়েছিল) একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত হয়েছে, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার অব্যাহত ধারা যে এরাই রক্ষা করে চলেছে, সে কথাও সমান সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে? যাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, সেই শিক্ষার্থীরা কোথা থেকে আসে? তাদের পরিচয় কী? এখান থেকে পাস করে তারা কোথায় যায়? প্রধানত দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে, অধিকাংশই গ্রাম থেকে, এরাই ভবিষ্যতে দেশের খ্যাতনামা অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, বিচারপতি, ম্যাজিট্রেট, আমলা হয়। সদাগরি অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে বড় বড় আমলা, বহুজাতিক কোম্পানির এক্সিকিউটিভ থেকে বিপণন কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কম্পিউটার কর্মী, এমনকি বিনা বেতনের সংস্কৃতি ও সমাজকর্মীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আসে। এককথায় আমাদের সমাজের প্রধান চালিকাশক্তি এরাই। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের দক্ষ এবং শিক্ষিত জনবলের যে চাহিদা তার সিংহভাগই শুধু নয়, বলা যায় পুরোটাই আসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানেই ছাত্ররাজনীতি, মাস্তানি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষকদের দলবাজি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, যৌন হয়রানির অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ প্রভৃতি প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু উঠে আসে না ৫০০ আসনের একটি হলে কীভাবে দুই হাজার ছাত্র বাস করে, তারা কী খায়, তাদের পড়ার জায়গা কোথায়? টিউশনি বা কাজ করে তারা মাসে কত টাকা পায়? তারা কীভাবে যাতায়াত করে, সর্বোপরি নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘেরাটোপের বাইরে সৃজনশীলতা ও মানবসেবার কী ধরনের দৃষ্টান্ত তারা রাখছে। প্রতিবছর পিএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পাতলা ডাল আর ছারপোকার কামড় খাওয়া শিক্ষার্থী। প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য এরা পড়াশোনার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার আগেই এরা খুঁজতে থাকে বেকারত্ব মোচনের পথ। কেননা এদের দিকে স্বপ্নচোখে চেয়ে আছে একটি পরিবার আর অসংখ্য মুখ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের অনার্স কোর্স শেষ করতে লাগে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় বছর। হলের দৈন্যদশা, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা আর অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করে চলেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই।
রাজনৈতিক কারণে, রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে অনেক সময়ই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো উত্তাল থাকে। সেখানে যেমন কারাবন্দী নেতা-নেত্রীদের মুক্তি দাবি করা হয়, তেমনি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড কিংবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনেরও প্রতিবাদ করা হয়। ছাত্রীদের হলের জীবনসংগ্রাম যে আরও কষ্টের এবং অবর্ণনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাঠকক্ষে জায়গা না পেয়ে মসজিদে কিংবা ফ্লোরে বসে তারা জ্ঞানচর্চা করে। দুজনের একটি কক্ষে পাঁচ থেকে আটজন ঘুমায় মেঝেতে। সেই ‘চিৎ-কাত বোর্ডিং’-এর (এতই কম জায়গা যে কাত হলে চিৎ হওয়া যাবে না) ছবি এই তো কদিন আগে প্রথম আলোর পাতায় ছাপা হয়েছে। ক্যানটিনে সকালবেলা রুটি-পরটার সঙ্গে পেঁপের ঘণ্ট, আর তা না পাওয়া গেলে পাউরুটি-কলা হচ্ছে নিত্যদিনের সাধারণ খাবার। দুপুরে কাঁকর মেশানো চালের শক্ত ভাত, আলু বা পেঁপের ঝোলের সঙ্গে মাইক্রোস্কপিক একখণ্ড মাছ অথবা মাংস; আর হলের বিখ্যাত পাতলা ডাল তো আছেই। বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি না পাওয়ায় খাবারের মান দিন দিন নামতে নামতে এখন এমন একপর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগান দূরে থাক, শরীর টিকিয়ে রাখা কঠিন। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের সমস্যার কথা না-ই বা বললাম। আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর, রাষ্ট্রের শিক্ষিত-দক্ষ এসব কর্মীর সমস্যা সমাধানে আমাদের কোনো সরকারই কি একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে পারে না।
তাই গোলাম মুরশিদের ভাষায় ‘বিশ্ব-বিদ্যা লয়’ নয়, এখনো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি না থাকলেও কিছুটা হলেও ‘বিশ্ব-বিদ্যার চর্চা’ হয়।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
jeweel1965@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.