কিজি তাকিউচি-ভূমিকম্পপ্রবণ জাপান কি পরমাণু চুল্লির যোগ্য?

গত শুক্রবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পে তহকু অঞ্চল এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, প্রথমবারের মতো সরকারকে পরমাণু চুল্লির ব্যাপারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে আশপাশের জনবসতি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই বিপজ্জনক অবস্থায় পেঁৗছেছে যে, 'পরমাণু চুল্লি যে নিরাপদ এবং সেভাবে ডিজাইন করে তৈরি',


এ ধারণা এখন ভেঙে গেছে। পরমাণু স্থাপনা নিরাপত্তায় ব্যর্থ হওয়ায় এখন একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে এসেছে : কী করে ভূমিকম্পপ্রবণ জাপান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে সহাবস্থান করবে?
ইমার্জেন্সি কোর কুলিং সিস্টেম, যা থেকে রিঅ্যাক্টরকে ঠাণ্ডা করার জন্য পানি দেওয়া হয়, তা ওইসব রিঅ্যাক্টর শীতল করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। যখন একটি ভূমিকম্প হয়, তখন রিঅ্যাক্টর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কেবল সেই ব্যবস্থাই রিঅ্যাক্টর থেকে নিঃসরিত তাপের কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে না। যদি সঠিকভাবে মূল জায়গাটিকে শীতল করা না যায়, তাহলে নির্গত জ্বালানি ভয়ানক ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইল আইল্যান্ডে পরমাণু কেন্দ্রে শীতল করার পানি সঠিকভাবে ঢালতে ব্যর্থ হওয়ায় ধ্বংসাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। এখন জাপানের রিঅ্যাক্টরের অবস্থাও তেমন দাঁড়িয়েছে।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার জেনারেশনের উন্নয়নের প্রাথমিক অবস্থায় নিরাপত্তা প্রশ্নে ইমার্জেন্সি কোর কুলিং সিস্টেম (ইসিসিএস) কতটা নির্ভরযোগ্য, সেই প্রশ্ন উঠেছিল। জাপানের মতো একটি অগ্রসর দেশেও এবার ইসিসিএসের সেই কার্যকারিতা ব্যর্থ হয়েছে।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশনগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু একটি দুর্ঘটনার সময় যদি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তাহলে প্ল্যান্টের সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণেই একাধিক বিদ্যুৎ জেনারেটর এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে যা-ই ঘটুক না কেন, ইসিসিএস ব্যবস্থা যেন সচল থাকে। কিন্তু বর্তমান সমস্যা বলছে, নিউক্লিয়ার ডিজাইনের ধারণায় আরো পরিবর্তন আনা দরকার। ১৯৯৫ সালে বিখ্যাত হানসিন ভূমিকম্পের পর সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টকে ভূমিকম্প প্রতিরোধে অধিক সাবধানতা গ্রহণ করে। ভূমিকম্প প্রতিরোধব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করা হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তা যথেষ্ট ছিল না।
এমনিতেই পারমাণবিক প্ল্যান্ট কাঠামো অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এর বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং বহুমুখী। অবশ্য এখনই এটা বোঝা যাচ্ছে না, এর বিদ্যুৎব্যবস্থাসহ পার্শ্ববর্তী সংযুক্ত অবকাঠামো কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং এটা ধারণা করা কঠিন যে, আবার কখন একটি কম্পন এসে ধাক্কা দেবে।
প্রাকৃতিক উৎসের অপ্রতুলতার কারণে জাপান জ্বালানিনীতির অংশ হিসেবে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থ্রি মাইল আইল্যান্ডের প্রকল্প বাতিলের পরও জাপান তার নীতিতে স্থির থাকে। ১৯৮৬ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ইউরোপীয় জাতিগুলো কিন্তু পরমাণু বিদ্যুতের ওপর ভরসার কথা ত্যাগ করেছে। অথচ এদিকে জাপান নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক জ্বালানির উৎস বৃদ্ধির ব্যাপারে মন্থর হয়ে পড়েছে।
পরমাণু জ্বালানিনীতির কাঠামো পুনর্বিবেচনার বিষয়টি বর্তমানে বিশ্লেষণের জন্য আছে। কিন্তু জাপান বর্তমান নীতিতেই স্থির থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্প অনেক পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল করে দিয়েছে। সেগুলো আবার চালু করতে সময় প্রয়োজন হবে। তাই আমাদের সতর্ক হয়ে বিবেচনা করতে হবে জ্বালানি সরবরাহের ব্যাপারে পরমাণু শক্তির ঝুঁকিগুলোকে। ভূমিকম্পের বিপজ্জনক দিকটিও ভাবতে হবে। পেছনে তাকিয়ে দেখতে হবে, এই ভূমিকম্পপ্রবণ দেশটিতে আমরা কতটা পরমাণু জ্বালানির ওপর ভরসা করব, আমরা পরমাণু কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব কি না। অন্যথায় অনেক মানুষই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিয়েশন নির্গমনের ভয়ে এবং এমন মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কারণে পরমাণু জ্বালানির ব্যাপারে সায় দেবে না।
লেখক : জাপানের আসাহি সিমবুন পত্রিকার সিনিয়র স্টাফ রাইটার।
আসাহি সিমবুন থেকে ভাষান্তর মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.