ভিনদেশের চিঠি-হূৎকমলের তরে

ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া। অ্যাডওয়ার্ডস হলের নর্থ কাটলারে একটি রুম পেয়েছি। এক কথায় চমৎকার। এয়ারকন্ডিশন, ফোন, ইন্টারনেট, সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুমও আছে। এত ভালো একটি পড়ার কিংবা থাকার ঘর আমার জীবনেও ছিল না।


অবাক ব্যাপার—এ দেশে হলে সিট পাওয়ার জন্য কোনো রাজনৈতিক বড় ভাই কিংবা প্রভোস্টের কাছে যেতে হয়নি। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সপ্তাহে ১৬ বেলা খাবারসহ ভাড়া ২৪৫ ডলার, এত সুবিধাসহ ভাড়াবাড়িতে থাকতে অনেক টাকা লাগত। সপ্তাহে বৃত্তি পাই ৫১২ ডলার। যেহেতু বিড়ি-সিগারেট কিংবা পানশালায় যাওয়ার কোনো অভ্যাস নেই, তাই কোনো অভাব-অভিযোগও নেই। মাঝেমধ্যে আমার সুপারভাইজার পরীক্ষার কিছু খাতা দেখতে দেন। তাতে ভালোই টাকা-পয়সা পাই। সেই টাকা ক্যামেরা, আইপ্যাড, আইফোনের মতো ভোগ্যপণ্যের পেছনে শ্রাদ্ধ করি, ঘুরতে যাই, সিনেমা দেখি। ্র্র
হলের চারপাশটা এত সুন্দর হবে, চিন্তাই করিনি। ছায়া সুনিবিড় বনের মধ্যে মনোরম এক শান্তির নীড়। রাজনীতি নেই, সন্ত্রাস নেই। আছে পড়াশোনার পরিবেশ, আনন্দের নানা আয়োজন। ইনডোর-আউটডোরে নানা রকম খেলাধুলার ব্যবস্থা। আধুনিক জিমনেসিয়াম, সামনেই নীল জলের সুইমিংপুল। চারপাশে বেশ কিছু সাদা ইজিচেয়ার। তরুণ-তরুণীরা কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে সুর্যস্নান করতে করতে বই পড়ছে। ফাইভ স্টার হোটেল হোটেল ভাব। এখানে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো হল নেই। মেয়েদের হলের সামনে বান্ধবীকে কল দিয়ে অপেক্ষায় থাকারও কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা একই হলে থাকে। প্রতি রুমে একজন ছাত্র বা ছাত্রী। পারস্পরিক সম্মতিতে যে কেউ যে কারও রুমে যেতে পারে, কারও কোনো আপত্তি নেই। যাদের পার্টনার আছে, তাদের জন্য বড় খাটওয়ালা রুমও আছে। পার্টনার বললাম, কারণ পশ্চিমাদের সম্পর্ক বড় অদ্ভুত জিনিস। এক ছেলে আরেক ছেলেকে পছন্দ করে, এক মেয়ে আরেক মেয়েকে পছন্দ করে। বিয়েও করে। আবার নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্কও আছে।
করিডরে, দেয়ালে একটি লেখা ঘন ঘন চোখে পড়ে, ‘উচ্চ শব্দ করা নিষেধ।’ প্রথমে বিষয়টি অত গভীরভাবে চিন্তা করিনি। কয়েক দিন পর শুক্রবার রাতে চারদিকে হইহুল্লোড় শুরু হলে বুঝলাম—ওই কথাটি কেন এত আয়োজন করে লেখা। পরদিন সকালে আমার এক প্রতিবেশী আইরিশ স্বর্ণকেশীকে ‘হাই’ বলতেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছো?’
‘ভালো না। একটুও ঘুম হয়নি।’
‘কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?’
‘রাতে এত শব্দ হচ্ছিল!’
সে খুব বিনীতভাবে বলল, ‘ওহ! সরি! আমার এক বন্ধু এসেছিল।’
‘তোমার কথা না-হয় বুঝলাম, কিন্তু পুরো হলেই কি বন্ধু এসেছিল?’
একমুঠো স্নিগ্ধ হাসিতে উত্তর দিল, ‘এ দেশে শুক্র-শনিবার রাতে মানুষ অনেক আনন্দ করে। পান-আহার করে। তোমাদের দেশে করে না?’ একটু অন্যমনস্কভাবে বললাম, ‘করে...কেউ কেউ প্রতিদিনই করে।’ মনে মনে বললাম, ‘আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই কত সমস্যায় থাকে! প্রতি সপ্তাহে এত আনন্দ আসবে কোত্থেকে!’
শীতের শুরু। ঠান্ডা বাতাস শীতবস্ত্রের কড়া নাড়ছে। তার পরও মেয়েদের পোশাক-আশাক যথারীতি সীমিত এবং খোলামেলাই আছে। এ দেশে ছেলেরাই বরং অনেক ঢেকেঢুকে জামাকাপড় পরে। প্রথম প্রথম স্বল্পবসনা সুন্দরীদের দেখলে নিজেকে খুব পুরুষ মনে হতো। পুরুষ থেকে মানুষ হতে বেশ কিছুদিন লেগেছে। আস্তে আস্তে অস্ট্রেলীয় কিছু বন্ধুবান্ধব হলো। তাদের একজনকে বললাম, ‘তোমাদের দেশের মেয়েরা সহজেই শরীর দেখায়, তাই না?’ ্র্র্র
‘হুঁ! কিন্তু কোনোভাবেই হূদয়টা দেখায় না!’
‘কেন? ওরা কি অতখানি হূদয়বতী নয়?’
‘কে জানে! নিকোলের সঙ্গে সংসার করছি দুই বছর। কিন্তু এখনো তাকে একটুও বুঝতে পারিনি।’
‘বলো কী! সে তো হরহামেশাই “লাভ ইউ, ডার্ল...” ্রবলে কী মধুর করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে!’ ্র্র
‘হুঁ। তুমি শুধু ভালোবাসাটাই দেখেছ, ভণিতাটুকু বোঝোনি। থাকো কিছুদিন, দেখবে, সম্পর্ক কত ভঙ্গুর, কত হূদয়হীন হতে পারে!’ ্র্র
ওর চোখেমুখে গভীর হতাশা দেখে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। তাই অনেকটা গর্ব করেই বললাম, ‘বাংলাদেশের মেয়েরা এমন নয়। তারা খুব হূদয়বতী হয়। আমি তো এক মেয়ের চোখের মধ্যেই তার হূদয়টা দেখেছি।’ ্র্র
‘তাই?’
‘হুঁ!’
‘সে কি তোমার ভালোবাসার কথা জানে?’
‘হয়তো জানে, কখনো বলা হয়নি।’
‘কেন?’
‘সব কথা কি আর মুখে বলা লাগে? ভালোবাসি বলেই তো ভালোবাসি বলিনি।’ ্র্র্র
শাখাওয়াৎ নয়ন
পিএইচডি গবেষণারত, ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া।
nayonshakhawat@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.