তিস্তা নদী-জীবনরেখার মরণদশা by তুহিন ওয়াদুদ

উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা হচ্ছে তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্তরের বিশাল জনপদের জীবন-জীবিকার মূলসূত্র কৃষি। ঢাকার সঙ্গে স্থানিক অধিক দূরত্ব এবং শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি না থাকার কারণে রংপুর, দিনাজপুরে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি-হেতু এখানকার জনপদ সম্পূর্ণতই কৃষিনির্ভর।


তিস্তার প্রতি যত্নশীল না হওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিজ উৎপাদন এবং বর্ষা মৌসুমে দুই পাড় চলে যাচ্ছে তিস্তার গর্ভে, বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
তিস্তাপারের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে পাঁচ লাখ হেক্টর জমি কৃষির উৎপাদন উপযোগী করে তুলতে ১৯৯০ সালে তিস্তার ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তা সেচপ্রকল্প করা হয়েছে; যার প্রথম পর্যায়ের কাজ ১৯৯৩ সালে শুরু করা গেলেও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ আজ পর্যন্ত শুরুই করা যায়নি। প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমি লক্ষ্য করে প্রকল্পের কাজ শুরু করলেও ৫০ হাজার হেক্টর জমির বেশি জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে হলে শুষ্ক মৌসুমে পাঁচ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন হলেও পাওয়া যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার কিউসেক পানি। এমনকি কখনো কখনো এক হাজার কিউসেকের নিচে নেমে আসছে এই পানির পরিমাণ। তিস্তা সেচপ্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিস্তার পানি চুক্তির মাধ্যমে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা খুব জরুরি। এমন একটি সময় ছিল যখন তিস্তা সেচপ্রকল্প ছিল না, তখন তিস্তাপারের অনেক মানুষ চরাঞ্চলে বসবাস করত এবং তিন বেলা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। সেচপ্রকল্প চালু হওয়ার পর অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে তারা প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপাদন করতে পারছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বদলে গেছে। কিন্তু বর্তমানে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে সেই সেচপ্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করা শুধু অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তা-ই নয়, অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে প্রথম পর্যায়ের কাজও। তিস্তাপারের মানুষ যে জীবনরেখার সহায়তায় প্রকৃত অর্থে জীবন ফিরে পাচ্ছিল, তা যেন মরণরেখার দিকে এগোচ্ছে। ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করা পর্যন্ত স্বাদেশিক প্রচেষ্টায় যে সেচপ্রকল্পকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন, তার প্রতি সরকারের উদাসীনতা ভীষণভাবে লক্ষণীয়। তিস্তা নদীকে খননের ভেতর দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পাড় বেঁধে দিয়ে নদীর প্রতি যে পরিচর্যা প্রয়োজন, তা সরকার-পরম্পরায় কেউই করছে না। তবে বর্তমান সরকার ২৩ কোটি টাকার যে সামান্য বরাদ্দ করেছিল তিস্তা নদী খননের জন্য তার কাজ শেষ হওয়ার আগেই উজান থেকে পানির প্রবাহ এসে সে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যারাজ নির্মাণের পর এই প্রথম বালু উত্তোলন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সরকার। বাংলাদেশের চিরাচরিত প্রচেষ্টা হচ্ছে সড়কগুলোর কাজ এমন সময় শুরু করা, যাতে করে বর্ষা মৌসুমে কাজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে—এ কথা বুঝিয়ে মোট কাজের মুনাফার চেয়েও অধিক মুনাফা অর্জন করা। কোনো সরকারই এটাতে গা করে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সড়কপথের কাজগুলো তো ক্ষমতাসীন সরকারেরই কেউ না কেউ করে থাকে। তিস্তা নদীর খননকাজও একই সূত্রে গাথা। পানি উন্নয়ন বোর্ড আর ওই কাজের ঠিকাদার উভয়ের কারণেই মূলত তিস্তার খননকাজ বন্ধ হলো। তবুও যেটুকু খনন হয়েছে, সেই বালু যদি দূরে ফেলা যেত তাতেও হয়তো খনন অংশটুকুতে পানি রিজার্ভ রেখে এ বছর যেটুকু সুবিধা পাওয়া গেছে, সেচপ্রকল্পের অধীন জমিগুলো তা আরও কয়েক বছর পেত। কিন্তু উত্তোলিত বালুর অধিকাংশই রাখা হয়েছিল পাশেই। ফলে যেখানকার বালু সেখানেই আবার ভরাট করবে নদী।
তিস্তার উজানে ভারত আটটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তুলছে। শুধু তাই নয়, তিস্তার পানিপ্রবাহের খাত পরিবর্তন করে তা অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। অভিন্ন নদীতে যখন উজানে যেকোনো ব্যবহারক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়, তখন ভাটির দেশের সঙ্গে আলাপ করে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে ভারত এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তিস্তার পানি ইচ্ছামতো ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, তিস্তার ওপর আরও ৫০টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। ফলে বাস্তবায়িত হচ্ছে না অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের তিস্তাপারের মানুষ।
কমে যাচ্ছে তিস্তার প্রবাহ। শুধু তা-ই নয়, গ্রীষ্মকালে পানির প্রবাহ এত কমে যায় যে পানির স্তর নেমে যায় অনেক নিচে। এই ধারাবাহিকতা যদি চলতেই থাকে তাহলে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে এই অঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা মরণরেখায় পরিণত হবে। অবহেলার কারণে প্রকৃতির আশীর্বাদ তিস্তা নদীর মরণদশা থেকে যদি উত্তরণ ঘটানো না যায়, তাহলে মুখ ফিরিয়ে নেবে প্রকৃতি। উত্তরাঞ্চলের কৃষি তথা জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। উজানের আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাঁধগুলো নির্মাণের কাজ ভারত সম্পন্ন করলে তিস্তায় শুকনো মৌসুমে আর কোনো পানিই পাওয়া যাবে না।
কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের তিস্তায় লং মার্চের সময় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল, তা দেখে কেউ কেউ মনে করতে পারেন এই উপস্থিতি ছিল জাতীয় পার্টির প্রতি মানুষের ভালোবাসার কারণে। বিষয়টি তা নয়। মূলত তিস্তার পানি বণ্টনের সঙ্গে তিস্তাপারের মানুষের ভাগ্য জড়িত বলেই তারা সেদিন উপস্থিত হয়েছিল। যখন তিস্তার পানি চুক্তি হবে মর্মে ভারতের প্রেসিডেন্ট মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন, তার প্রাক্কালে ন্যায্য পানির দাবিতে সেখানে একটি নৌ-মিছিলে রিভারাইন পিপলের পক্ষ থেকে আমিও অংশ নিয়েছিলাম। সেদিনও দেখেছি গণমানুষের ঢল নেমেছিল তিস্তার বুকে। যে তিস্তা এই জনপদের জীবনরেখা, তাকে বাঁচাতে স্বাদেশিক প্রচেষ্টার কমতি থাকা কাম্য নয়।
 তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সিনেটর, রিভারাইন পিপল।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.