আইলার এক বছর-খাওয়ার পানির সংকট মোকাবিলায় by শামীম আহমেদ ও হাসিন জাহান

নব্বই দশকের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিচিত ছিল বন্যার ভয়াবহতার কারণে। বড় বন্যাগুলোয় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ছিল নিত্যনৈমিক্তিক ঘটনা। কিন্তু ধীরে ধীরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মুন্সীয়ানা অর্জনের কারণে প্রাণহানির ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সূচকে।


যেখানে আগে বিদেশি সাহায্য ছাড়া এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা ছিল অসম্ভবপ্রায়, সেখানে এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামত বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর কিংবা আইলা আমাদের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৎস্য চাষ ও কৃষিকাজ যদিও উপকূলের মানুষের প্রধান পেশা, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আয়ের এই উৎসগুলো আজ বিপন্নপ্রায়। সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায় ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ৪০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এক বছর পার হলেও আজও প্রায় ৭ লাখ মানুষ সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে জীবন ও জীবিকার জন্য। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জুন ২০০৯-এর পরিসংখান অনুযায়ী চার হাজারের বেশি সংরক্ষিত পুকুর, এক হাজারের বেশি পিএসএফ (Pond Sand Filter) এবং ১৩ হাজারেরও বেশি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আইলায়। এর বাইরেও দুই লক্ষাধিক ল্যাট্রিন আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটতে পারে। আইলার মতো ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে যে ক্ষতি বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় হয়েছে, তা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অকল্পনীয়। আমরা যদি শুধু সাতক্ষীরা জেলার তিনটি উপজেলা শ্যামনগর, দাকোপ ও কয়রার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করি, তাও আমাদের মতো একটি দেশের পক্ষে স্বল্প সময়ে সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে ওঠা অসম্ভবপ্রায়। এই এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাড়িঘর ধসে গেছে, চাষের জমি তলিয়ে গেছে, গবাদিপশু মারা গেছে। লবণাক্ততার কারণে পুকুরের মাছ মরে পরিবেশ দূষণ করেছে। নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সহায়তা সত্ত্বেও উপকূলবর্তী এলাকার অর্থনীতি এখনো জেগে ওঠেনি, মানুষের জীবন ও জীবিকা রয়ে গেছে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায়। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মানুষের মৌলিক চাহিদা এখানে এখন বিলাসিতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এত কিছুর পরও ঘূর্ণিঝড় আইলা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষের মূল চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি। চারদিকে থৈ থৈ পানি থাকা সত্ত্বেও খাওয়ার পানির অভাবে মানুষের জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোয়। সাধারণ সময়েও মানুষকে খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য মিঠাপানির পুকুর কিংবা টিউবওয়েলের পানির ওপর ভরসা করতে হয়। ঘূর্ণিঝড় আইলায় এই এলাকার অধিকাংশ টিউবওয়েল পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। আজ এক বছর পরও অধিকাংশ টিউবওয়েল ব্যবহারের অনুপযোগী রয়ে গেছে। যেগুলো ব্যবহারের উপযোগী হয়েছে, সেগুলোও লবণাক্ততার জন্য পরিত্যক্তপ্রায়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আগে মিঠাপানি হিসেবে পরিচিত পুকুরের পানিও ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে লবণাক্ত হয়ে গেছে।
এখন সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি উপজেলা শ্যামনগর, দাকোপ ও কয়রার পানিদুর্দশার দিকে তাকানো যাক। শ্যামনগর উপজেলা খুবই খারাপভাবে আক্রান্ত হয় জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে। ১৫০টি পিএসএফ ও তার সন্নিবেশিত পুকুর, ৮০০ টিউবওয়েল এবং আরও ৮০০টি পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, যা আগে খাওয়ার পানির জন্য ব্যবহূত হতো। এই তিনটি উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এর মধ্যে সোয়া এক লাখের বেশি এখনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। এই জনগোষ্ঠীর দুই মাসের খাওয়ার পানির চাহিদা প্রায় এক কোটি ৪২ লাখ লিটার (জনপ্রতি প্রতিদিন দুই লিটার ধরে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল)। বেসরকারি সংস্থাগুলো দুই মাসে সর্বোচ্চ সাত লাখ লিটার পর্যন্ত এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দুই মাসে তাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে সরবরাহ করতে পারবে সর্বোচ্চ চার লাখ ২০ হাজার লিটার পর্যন্ত পানি। এর পরও চাহিদার একটি বিরাট অংশ, প্রায় এক কোটি ৩১ লাখ লিটার পানির (প্রতি দুই মাসে) ঘাটতি রয়েছে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত সাতক্ষীরার তিনটি উপজেলায়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে সামনের দিনে এই এলাকার মানুষের খাওয়ার পানির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হলে স্থানীয় জনসাধারণকে সচেতন ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিয়োজিত করতে হবে। শুধু দুর্যোগকালীন পানি সরবরাহ করে কিংবা পরবর্তী সময়ে টিউবওয়েল মেরামত ও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণের মাধ্যমে খাবার পানির সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। এ জন্য চাই উদ্ভাবনী ও বাস্তবসম্মত প্রযুক্তি এবং উদ্যাগ।
আমরা মনে করি, উপকূলতীরবর্তী অঞ্চলগুলোর খাওয়ার পানির সংকট উত্তরণে দুটি কাজ করা যেতে পারে। প্রথমত, স্বল্প খরচে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রযুক্তি সরবরাহ। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে যদিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এলাকায় খাওয়ার পানি সরবরাহের চেষ্টা করেছে কিন্তু দুর্গম এলাকায় তাদের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এসব এলাকা অত্যন্ত দুর্গম, কর্দমাক্ত এবং এখানে পানি সরবরাহ করা কিংবা এলাকার মানুষের পক্ষে বাইরে থেকে পানি সংগ্রহ করা অসম্ভবপ্রায়। এই প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হচ্ছে এর জন্য কোনো স্থায়ী ছাদ লাগে না, যেকোনো ছাদ বা উঠানে প্লাস্টিক শিট স্থাপন করা যায়। এটি স্বল্পব্যয়ী, স্থানান্তরযোগ্য, সহজেই পরিষ্কার করা যায় এবং উপকরণগুলো স্থানীয়, টেকসই ও ব্যবহারবান্ধব। সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ নেই বললেই চলে।
দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ-সহনশীল পুকুর সংরক্ষণ। আইলায় প্রায় এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার উপকূল ক্ষতিগ্রস্ত এবং জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। যেহেতু পুকুরগুলোর পাড় যথেষ্ট উঁচু ছিল না, সেহেতু জলোচ্ছ্বাসে সেগুলো সহজেই প্লাবিত হয়। স্থানীয় জনগণ উপলব্ধি করে যে দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ে খাওয়ার পানির অন্যতম সংস্থান হতে পারে সংরক্ষিত মিঠাপানির পুকুর, যা পিএসএফ প্রযুক্তির মাধ্যমে খাওয়ার উপযোগী করে তোলা সম্ভব। স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় উপকূলবর্তী প্রতিটি জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে দুটি পুকুর সংরক্ষণ ও দুর্যোগ-সহনশীল করে তোলা দরকার, যেগুলো মাছ চাষ কিংবা অন্য কারণে লিজ দেওয়া যাবে না। এই পুকুরগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে স্থানীয় সরকারের কাছে কিন্তু পরিচালিত হতে হবে স্থানীয় জনগণের যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য মতামতের ভিত্তিতে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এসব পুকুরে পিএসএফ বসানোর দায়িত্ব নিতে পারে। এর ফলে একটি সমন্বিত উদ্যাগের মাধ্যমে উপকূলবর্তী অঞ্চলের ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের খাওয়ার পানির সংকট সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।
শামীম আহমেদ: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
shamim@shamimahmed.net
হাসিন জাহান: প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ।
hasin.jahan@wateraidbd.org

No comments

Powered by Blogger.