চারদিক-ভাঙল মিলনমেলা, ভাঙল by সুপ্রীতি ধর

তখন রাত কতই বা হবে, সাড়ে নয়টা-দশটা, বা তারও বেশি। ঘড়ি দেখতেও ভয় পাচ্ছিল সবাই। ভেতরে মঞ্চে গান গাইছেন তিমির নন্দী, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই’। হলভর্তি মানুষ চুপ, কারও চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল কি না জানা গেল না অন্ধকারে। আড্ডাটা তো আসলেই আর নেই।


মস্কোর গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ নম্বর আর ৭ নম্বর হোস্টেল ছিল আড্ডার প্রাণ। কত হই-হুলোড়, কত হাসাহাসি, কত সুখ-দুঃখ, ভালোবাসার ইতিহাস—সবই আজ পেছনে ফেলে আসা।
বলছিলাম রাশিয়ার গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত দিনভর এক মিলনমেলার কথা। বৃহস্পতিবার ঢাকায় মহানগর নাট্যমঞ্চে সোভিয়েত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল এ উৎসবের। হ্যাঁ, উৎসবই তো। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের অসংখ্য ছাত্র সেখানে পড়ালেখা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেকেই স্বনামে খ্যাত আজ। তাঁদের অনেকেই সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন শুধু তারুণ্যের সেই সোনালি দিনগুলোকে আবারও ঝালাই করে নিতে। ষাটোর্ধ্ব, পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষগুলোর বয়স যেন কমে গিয়েছিল এক ঝটকায়। তবে চল্লিশের ঘরের মানুষেরই যেন জয়জয়কার ছিল। তাঁদের তারুণ্য এখনো যেকোনো বয়সকে হার মানায়।
শুধু ঢাকারই নয়, উৎসবে যোগ দিতে ঢাকার বাইরের শহর খুলনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ঠাকুরগাঁও ছাড়াও সুদূর কানাডা, আমেরিকা আর রাশিয়া থেকেও এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। উৎসবটা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সবারই উৎসবে পরিণত হয়েছিল দিনটি। সকাল থেকেই একের পর গাড়ি এসে থামছে আয়োজনস্থলে, আর হইচইয়ে ভরে উঠছে পুরো এলাকা। সেই তিয়াত্তর সালের শিক্ষার্থী যেমন এসেছিলেন, তেমনি এসেছিলেন একেবারে নবীন জনও। সবার মুখেই হাসি। ব্যক্তিগত জীবনে আজ সবাই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলেও, চুলে সাদা আঁচড় পড়লেও সবাই যেন একটি দিনের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন সেই সদ্য তারুণ্যপ্রাপ্ত বয়সটিতে; বিশেষ করে সেই আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি কিউরেটর ছিলেন, তাঁকেও ডেকে আনা হয়েছিল এই উৎসবে।
এত দিন পর পিতৃতুল্য মানুষটিকে পেয়ে যেন আনন্দ আর ধরে না। আরও একপ্রস্থ যোগ হলো, যখন তিনি মঞ্চে উঠে বললেন তিথি আপার কথা, যিনি ওই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিলেন। শুনে আজকের পঞ্চাশোর্ধ্ব তিথি আপার কেমন লেগেছিল জানি না, কিন্তু হলজুড়ে খুশির রেশ বয়ে যায় তখন।
সকাল থেকে ছিল স্মৃতিচারণা পর্ব। কত রকমের স্মৃতি! তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে যাঁরা গিয়েছিলেন মস্কোতে, সবাইকে বিদায় জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। স্মরণ করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সহপাঠীদের। অনেকে এখন আর নেইও, স্মরণ করা হয় তাঁদেরও। মঞ্চে যখন চলছিল এসব স্মৃতিচারণা পর্ব, মিলনায়তনের কোণে কোণে তখন টেবিল জুড়ে বসেছিল প্রাণোচ্ছল আড্ডা।
এখানে বয়স কোনো বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে মন। সারা দিনই চলে গান, আবৃত্তি, কৌতুক ছাড়াও আরও কত কী! দেখানো হয় একটি তথ্যচিত্র। বিকেলের মূল পর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটির শুভ সূচনা করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, আর সাংসদ রাশেদ খান মেনন। ছিলেন রুশ ফেডারেশনের রাষ্ট্রদূত গেন্নাদি পি. ত্রৎসেঙ্কো। রুশ-ফেরতা বাঙালিদের এই মিলনমেলা তিনি উপভোগ করলেন। রুশ গানের সঙ্গে কণ্ঠও মেলালেন, উৎসাহ দিলেন সবাইকে। এরপর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান তিমির নন্দী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। স্পন্দন পরিবেশন করে নাচ, আর জাগরণের গান তো ছিলই। রেজওয়ানা চৌধুরী শুধু নিজেই গাননি, গাইয়ে ছেড়েছেন সবাইকে; বিশেষ করে ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ গানটিতে গলা মেলাতে গিয়ে সবাই যেন প্রবাসের সেই দিনগুলোতেই ফিরে গিয়েছিলেন। এই গানগুলোই তো তখন ছিল আমাদের সবার আসরের মূল গান।
কী সোনালি সময়ই না ছিল সেই দিনগুলো! সবে কলেজের গণ্ডি পেরোনো একজন তরুণ বা তরুণী একেবারেই ভিন দেশে ভিন ভাষাভাষী মানুষের মাঝে পড়ে নিজেকে একটু একটু করে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে কখন যে দেশটিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল, টেরই পেল না; বিশেষ করে চল্লিশের ঘরে যিনি আজ, তিনি তো রাশিয়ার ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। একটি দেশের ভাঙা-গড়ার সাক্ষী তিনি। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের ফারাকটা ভালোই উপলব্ধি করেছেন তিনি। কাজেই জীবনের চরম সুন্দরতম সময়টি ওই দেশটিকে দিয়ে এসে মন তো খারাপ হওয়ারই কথা। আর তাই বৃহস্পতিবার যখন সবাই একে অপরকে পেলেন, ভুলেই গেলেন জাগতিক সব দৈন্য। জানি না, বিশ্বের অন্য দেশের যাঁরা পড়াশোনা করেন তাঁদের মাঝে আমাদের মতো এমন সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে কি না! এই যে বন্ধুত্ব, প্রাণের টান, এ একেবারেই নির্ভেজাল; এখানে কোনো স্বার্থ নেই, নেই হিংসা, প্রতারণা—কিছুই নেই। আছে শুধু প্রাণ খুলে কথা বলার মতো, হাসার মতো শক্তি।
দিনশেষে তাই যখন বিদায়ের পালা, সবারই মন ভারী। আবার দেখা হবে তো!

No comments

Powered by Blogger.