প্রতিক্রিয়া-‘বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর আস্তাকুঁড়?’-বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন

গত ৩০ এপ্রিল প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাদাসিদে কথা কলামে ‘বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর আস্তাকুঁড়?’ লেখাটি আমাদের বিস্মিত করেছে। জাহাজভাঙা-শিল্পের বহু ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও সেগুলো বিবেচনায় না এনে শুধু দুটি নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে লেখাটিতে।


উন্নত বিশ্বের তুলনায় সস্তায় শ্রম প্রাপ্তির কারণে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নতুন শিল্প গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জাহাজভাঙা-শিল্পের মতো প্রতিষ্ঠিত ও বিকাশমান একটি শিল্প আদৌ শিল্প কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে শুধু পরিবেশ ও শ্রম মজুরির দোহাই দিয়ে লেখক জাহাজভাঙা-শিল্পকে একেবারে তুলে দেওয়ার দাবি করেছেন। একবারও কি তিনি ভেবে দেখেছেন, এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত মালিক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে লাখ লাখ মানুষের রুজি-রোজগারের কী ব্যবস্থা হবে? জাহাজভাঙা-শিল্পের বদৌলতে দেশের বাজারে আমরা যেসব জিনিস অতি সুলভ মূল্যে পাচ্ছি, ওইগুলো কোত্থেকে আসবে?
জাফর ইকবালের মতে, ‘দেশের আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেউ যদি টাকা কামাই করতে শুরু করে, তাহলে সেটাকে কি শিল্প বলা যায়?’ জাহাজভাঙা-শিল্পের মালিকেরা দেশের আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না—এমন ধারণা সঠিক নয়। দেশের আইন ও নিয়মনীতির দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারের, এমন কথা লেখার আগে একবার খোঁজ নিয়ে দেখে নেওয়া যেত।
একটা শিল্প গড়ে উঠতে হলে তাকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। জাহাজভাঙা-শিল্পের মালিকেরা সেই পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে পারছেন না দাবি করে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, জাহাজভাঙা আদৌ শিল্প কি না। এ কথা তো সবার জানা যে, অনেকগুলো মূল উপকরণের ওপর ভিত্তি করে একটা শিল্প গড়ে ওঠে। একটা শিল্পের অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে অবকাঠামো, উৎপাদন-প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরণ। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র হচ্ছে ওই সব মূল উপকরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিল্পকে জনস্বার্থে পরিচালনা করার একটি উপ-উপকরণ মাত্র।
একটি প্রামাণ্যচিত্রে শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে তিনি এমন দাবি করে বসলেন, যাতে করে শ্রমিকদের রুজি-রোজগারের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। আবার তিনিই লিখেছেন, শ্রমিকেরা তাঁদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে অভিযোগ করেননি। তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করে গেছেন। হাসি-তামাশা করেছেন।
যদিও জাহাজভাঙা-শিল্পে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, তবু তাঁর কথায় জাহাজভাঙার কাজে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ হাজার। এ তো শুধু জাহাজভাঙার শ্রমিক। কিন্তু ভাঙার পরে শিতলপুর থেকে শুরু করে মাদামবিবির হাট, কদমরসুল, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, কর্নেলহাট, সাগরিকা রোড, পোর্ট কানেকটিং রোড, সিডিএ মার্কেট, মোগলটুলী, মাদারবাড়ী পর্যন্ত বিশাল জাহাজভাঙার মার্কেটের সঙ্গে জড়িত আছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও কর্মচারী। তাঁদের কর্মসংস্থানের যে ব্যবস্থা করেছে এই শিল্প, তার কথা ভাবতে হবে না?
লেখাটিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, দেশের রি-রোলিং মিল ও স্টিল মিলের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মাত্র এক-চতুর্থাংশ জাহাজভাঙা-শিল্প জোগান দিয়ে থাকে, যা না হলেও খুব একটা কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এ তথ্য মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে জরুরি অবস্থা চলাকালীন যখন দেশের আমদানি-রপ্তানি ও ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে স্থবির, তখনকার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ২০০৭-০৮ বছরে জাহাজভাঙা-শিল্পে আমদানীকৃত জাহাজের মোট ওজন নয় লাখ ৭২ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন। আর ২০০৮-০৯ বছরে জাহাজভাঙা-শিল্পে আমদানীকৃত জাহাজের মোট ওজন ২২ লাখ ১৭ হাজার ৯০ মেট্রিক টন। দেশের রি-রোলিং ও স্টিল মিলগুলোর প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৭০ শতাংশেরও অধিক এই জাহাজভাঙা-শিল্প জোগান দিয়ে থাকে।
নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি তথা কলকারখানা নির্মাণের যাবতীয় অবকাঠামোসহ অভ্যন্তরীণ সব ধরনের নৌযান নির্মাণ ও মেরামতের প্রয়োজনীয় স্টিল প্লেট, গার্ডার, পাইপ মেশিনারিজ, খুচরা যন্ত্রাংশসহ প্রায় ৯৫ শতাংশ জিনিস আমরা জাহাজভাঙা-শিল্প থেকে পাচ্ছি, যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কাঠের ফার্নিচার তথা টেবিল, চেয়ার, খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্ডরোব, সোফাসেট ইত্যাদিসহ অভ্যন্তরীণ গৃহসজ্জার প্লাইবোর্ড, শিট ইত্যাদি মিলে বার্ষিক জাতীয় চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তথা তিন থেকে চার লাখ টন জাহাজভাঙ্গা-শিল্প জোগান দিয়ে আসছে। ফলে দেশের কাঠশিল্প রক্ষায় তথা সবুজ বনায়ন প্রক্রিয়ায় জাহাজভাঙা-শিল্পের অবদানও কম নয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাহাজভাঙা কার্যক্রম নেই বলে লেখক দাবি করেছেন। আসলে জাহাজভাঙা কার্যক্রম যেকোনো দেশে কিংবা যেকোনো স্থানে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। প্রকৃতির অপার অনুগ্রহে আমাদের সীতাকুণ্ড উপকূলে সহায়ক ভৌগোলিক অবস্থান বিদ্যমান থাকায় শুধু ওই স্থানেই এ শিল্প গড়ে উঠেছে; দেশের অন্য কোনো স্থানে নয়। তা ছাড়া অন্য কোনো দেশে এই শিল্প আছে কি নাই, তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না।
একটা শিল্পের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতেই পারে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য উপায় ও প্রস্তাবনা নিয়ে এগিয়ে না এসে বিকাশমান একটি শিল্পকে বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানানোর মানসিকতা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসা উচিত।
এই শিল্প বন্ধ করে দিলে এই শিল্পের সাথে জড়িত বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তাঁরা কি করতে পারবেন? কিংবা এই শিল্পের মাধ্যমে প্রাপ্ত পণ্যগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা তাঁরা গড়তে পারবেন?
আমাদের দেশের সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, রাসায়নিক শিল্প, চামড়া শিল্প ইত্যাদির কারণেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পোশাকশিল্পেও শ্রমিকেরা কম মজুরি পাচ্ছেন। তাই বলে কি ওই সব শিল্প বন্ধ করে দিতে হবে?
জাহাজভাঙা-শিল্পে শ্রমিকের অসুস্থ হওয়া, আহত হওয়া কিংবা নিহত হওয়া কি ওই শিল্পের অপরাধ? অন্য কোনো শিল্পের শ্রমিক কি অসুস্থ, আহত কিংবা নিহত হয় না? অথচ জাহাজভাঙা-শিল্পের মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তথা চিকিৎসার সুবিধা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। জাহাজভাঙা-শিল্পের মালিকদের যৌথ উদ্যোগে শ্রমিকদের সুচিকিৎসার জন্য ভাটিয়ারীতে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি বিশাল হাসপাতাল কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ প্রায় সমাপ্তির পথে।
জাহাজভাঙা-শিল্পে পরিবেশগত কিংবা শ্রমিক মজুরির মতো সমস্যা থাকতেই পারে। মাথাব্যথা আছে বলে মাথা কেটে ফেলতে হবে—এটা কোনো সমাধান নয়। আমাদের উচিত হবে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে আলোচনার মাধ্যমে ওই সব সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।
আসুন, প্রকৃতির অপার অনুগ্রহে প্রাপ্ত সাগরের সহায়ক ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তির করে সীতাকুণ্ড উপকূলে দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা জাহাজভাঙ্গা-শিল্পকে রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য আমরা সম্মিলিত প্রয়াস অব্যাহত রাখি এবং চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হই।

No comments

Powered by Blogger.