সহজিয়া কড়চা-শিক্ষার তিন অবস্থা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

শিক্ষার জন্য আমাদের সরকার যত টাকা ব্যয় করে তার চেয়ে বেশি ব্যয় করে বাক্য। সরকারি কর্তারা ব্যয় করেন বাক্য, আর শিক্ষক ও শিক্ষাবিদেরা আয় করেন অর্থ। শিক্ষা নিয়ে সংবাদপত্রের আয়ও নাই, কোনো ব্যয়ও নাই। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে তাঁরা শিক্ষা নিয়ে পত্রিকার পাতা ভরান। এখন ডিজিটাল যুগ। সুতরাং অক্ষরের চেয়ে ছবির পরিমাণ বেশি।


কোচিং সেন্টারের প্রকাণ্ড বিজ্ঞাপনে অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র ছবি থেকে পাতাজোড়া ছবি—প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল গ্রুপ ছবিও।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার সঙ্গে পাবলিক পরীক্ষার সম্পর্ক পাখির সঙ্গে পালকের যে সম্পর্ক তা নয়—প্রাণীর সঙ্গে লেজের যে সম্পর্ক তাই। অর্থাৎ একেবারে অবিচ্ছেদ্য। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের মতো স্কুলে কিছুদিন পড়লাম কিন্তু পরীক্ষা দিলাম না, তা নয়। আধুনিক কলোনিয়াল শিক্ষার লক্ষ্যই হলো পাস করা। মরো আর বাঁচো—পাস তোমাকে করতেই হবে। এ যুগের শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল নন যে পরীক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করবেন। যদিও তাঁরা দুজনই পরীক্ষা দিলে খুব ভালো ফল করতেন। কিন্তু পরীক্ষাকে তাঁরা মনে করেছেন নিষ্প্রয়োজনীয় এক বিপজ্জনক কসরত। পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিলে আজকাল শুধু শিক্ষার্থীদেরই লাভ তা নয়, মিষ্টির দোকান-মালিকের লাভ বহুগুণ বেশি। গুণগত নয়, মানগত নয়—সংখ্যাগত দিক থেকে পরীক্ষার ফল যত ভালো হবে, ময়রার দোকানের লাভ তত বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রথম এসএসসি বা ম্যাট্রিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম বছরই বিপুল ফেল। প্রতি চারজনের একজনও পাস করতে পারেননি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে সবসুদ্ধ পাস করেছিলেন ২১৯ জন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ প্রভৃতি থেকে সর্বসাকল্যে পাস করেছিলেন ১৬২ জন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি পাস করেছিলেন প্রথম বিভাগে। বঙ্কিমবাবুদের এসএসসির ফল যেদিন বের হয় সেদিন শ্যামবাজারের ভীমনাগের দোকানে যে আড়াই কেজি সন্দেশ বেশি বিক্রি হয়েছিল, সে প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
অনুমান করি, পাস করার সংবাদ শুনে বঙ্কিমবাবু মন্দিরে গিয়েছিলেন—ময়রার দোকানে যাননি। পত্রপত্রিকা ছিল খুবই কম, সুতরাং প্রথম বিভাগে পাস করনেওয়ালাদের ছবি তুলতেও কেউ তাদের বাড়িতে আসেনি। সেদিন তাদের টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ঘিরে ধরার প্রশ্নই আসে না। সেকালে ফল প্রকাশের দিন ও তার পরবর্তী কয়েক দিন অবশ্য অনেক কিছুই হতো না। কলেজে ভর্তির ফরম কিনতে বঙ্কিমচন্দ্র অথবা তাঁর বাবা যাদববাবু কাঠালপাড়া থেকে কলকতায় এসে চটি জুতার শুকতলি খুইয়ে গিয়েছিলেন, সে তথ্যও আমাদের জানা নেই। চারটি বছর কলেজের করিডরে পড়ে থাকারও প্রয়োজন হয়নি। এক বছর পরেই ১৮৫৮-তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিএ পরীক্ষার প্রবর্তন করে। বঙ্কিমচন্দ্র পরীক্ষা দেন। প্রথমবার বঙ্গ, বিহার, ওডিশা, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৩ জন। ফলাফল যেদিন বের হলো সেদিন ১১ জনের মাথায় হাত। পাস করলেন মাত্র দুজন। তাঁদের একজন আমাদের বঙ্কিমবাবু আর একজন হলেন যদুনাথ বসু। অর্থাৎ একালের সমস্ত সার্ক দেশের মধ্যে প্রথম বিএ পাস হলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। সেদিনও যে ভীমনাগের দোকানে বেশি বেচাকেনা হয়েছিল, তা নয়।
বঙ্কিমবাবু বিএ পাস করেছিলেন দ্বিতীয় বিভাগে। এসএসসি পাস করার আগেই ইংরেজি সাহিত্যের এলিজাবেথীয় যুগের স্পেন্সার, জন ডান, ক্রিসটোফার মারলো, শেক্সপিয়ার থেকে মিল্টন, জন ড্রাইডেন, জোনাথান সুইফট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, বায়রন, শেলি, স্কট প্রমুখের লেখা পড়ে শেষ করেন। ভিক্টোরীয় যুগ তো বঙ্কিমবাবু অব্যবহিত আগের যুগ। যে যুগের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ যে তিনি সবই পড়েছেন তাতে সন্দেহ কী? সংস্কৃত সাহিত্যও প্রচুর পড়া ছিল চাটুজ্জ্যের। তাঁর চেয়ে ভালো বাংলা গদ্য আজ পর্যন্ত কেউ লেখেননি।
এবার কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা-সমীক্ষার মধ্যে যাইনি। আর কোনো দিন যাবও না। গতবারের আগেরবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে কয়েকটি কোচিং সেন্টারের সামনে জড়ো হওয়া প্রায় ৯০ জন উচ্চশিক্ষাপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুন্সী মেহেরুল্লাহ, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র সেন, স্বর্ণকুমারী দেবী ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কে? দুঃখে আমার বুক ফেটে যায়, তাদের একজনও জবাব দিতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককে বলেছি, এদের একজনের ছেলেকে চেন, তার বাপকে চেন না। তারপরও বলতে পারেনি। লজ্জিত হওয়ার লক্ষণও চোখে-মুখে লক্ষ করা গেল না। কারও কারও মোবাইল ফোনে গানের টোন বেজে ওঠায় আমার কবল থেকে রেহাই পায়।
আমাদের সবচেয়ে বড় সৃষ্টিশীল লোকটি লম্বা চুল রেখে ঘাড় নিচু করে শুধু পদ্য লিখতেন না, বাপের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারিটাও দেখাশোনা করতেন। তা ছাড়া একালের কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের মতো একটা ইসকুলও খুইলাছিলেন কবি ইসকুল খুইলাছিলেন। সেটা ১১০ বছর আগের কথা। এখন একটা কিন্ডারগার্টেন বা কোচিং সেন্টার খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার মালিক লাল হয়ে যান। বিনা পুঁজিতে তাঁর রোজগার একটি মাঝারি শিল্পপতির আয়কে ছাড়িয়ে যায়। রবিবাবু ইস্কুল খুলে ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় গত ১১০ বছরে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি করেছেন মাত্র দুজন মানুষ। একজন রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন মহাত্মা গান্ধী। চাঁদাবাজি শব্দটা রবীন্দ্রনাথের সময় প্রচলিত ছিল না। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষাপাত্র লইয়া দ্বারে দ্বারে ঘুরিতেছি।’ শিশু অভিভাবকের ঘাড় মটকানোর চেয়ে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ধনীদের দরজায় গিয়ে করাঘাত করাকে তিনি শ্রেয় মনে করতেন। তবে দানের টাকাটা পেয়েই দলবল নিয়ে বড় হোটেলে গিয়ে ঢুকে পড়তেন— সে প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাইনি। ১৯০১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঠাকুর তাঁর সম্ভাব্য দাতাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন:
‘শান্তিনিকেতন আশ্রমের সঙ্গে একটি বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ করিয়াছি। বিদ্যালয় গৃহ পূর্ব্বেই নির্ম্মাণ হইয়া গেছে—এক্ষণে ষোলো জন ছাত্রের উপযোগী একটি বাড়ি তৈরি হইতেছে। যাহাতে শিক্ষার সঙ্গে ছাত্রের বুদ্ধি, শরীর ও চরিত্রের উন্নতি হয় সেজন্য বিশেষ চেষ্টান্বিত হইব। বিষয়কর্ম্মের ঝঞ্ঝাট পরিত্যাগ করিয়া আমি এই বিদ্যালয় লইয়া শান্তিনিকেতনে নিভৃতে জীবনযাপন করিতে ইচ্ছা করিয়াছি। দেশের জন্য যেমন করিয়াই যাহা করিতে যাই গোড়ায় মানুষ দরকার—বাল্যকাল হইতে...শ্রদ্ধা সংযম ও অবধানের সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা না করিলে কেবল মুখস্থ বিদ্যায় কেহ মানুষ হইতে পারে না।’
কী সাংঘাতিক নিষ্ঠুর দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা? শিক্ষার সঙ্গে ছাত্রের বুদ্ধি ও চরিত্রের উন্নতির দরকারটাই বা কী? রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, একদিন দেশ স্বাধীন হবে, সেই দেশ গঠন করতে ‘গোড়ায় মানুষ দরকার’। কল্পনাবিলাসী বলে ও-কথা বলেছেন। বাস্তববাদী মানুষ হলে বলতেন, মানুষের প্রয়োজন নেই ক্যাডার দরকার। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন। আজ যদি বলতেন, ‘কেবল মুখস্থ বিদ্যায় কেহ মানুষ হইতে পারে না’ তাহলে দুই বাংলার ফটোকপির দোকান-মালিকেরা ঐক্য পরিষদ গঠন করে জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথের বাড়িটি জ্বালিয়ে দিতেন। এদিকে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে হতো ভাঙচুর— যেমন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চতুর্দিকের দোকানপাটে ও যানবাহনে আজকাল হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ নজরুল ইসলামের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি মনে করতেন, ইংরেজ-প্রবর্তিত আমাদের কলোনিয়াল শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ’ করে, কিন্তু ‘বাহির হইল পঙ্গু মন ও জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া’। এই বক্তব্য এ-কালে আরও বেশি সত্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘পরীক্ষা ফলের প্রতি অতিমাত্র লোভ করিয়া কলেজে শেখাইবার চেষ্টা’ হওয়ায় ছাত্রদের ‘বুদ্ধি বন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে’।
‘যাইতেছে’ কথাটি বলেছেন তিনি নব্বই বছর আগে। এই নব্বই বছরে তা যেতে যেতে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধি একেবারে বন্ধ্যা হয়ে গেছে। সারা দিন কম্পিউটারে ঠোকাঠুকি করলে, অথবা প্রতি দশ মিনিট পরপর মোবাইল ফোনে দীর্ঘ কথা বললে, কিংবা নেতার নির্দেশমতো টেন্ডার কেন্দ্রের আশপাশে গিয়ে মোতায়েন হলে মন পঙ্গু হবেই এবং জ্ঞানের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা না হয়েই পারে না। অথচ পৃথিবীর যেকোনো অগ্রসর জাতির যে মেধা আছে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও সেই পরিমাণ মেধা আছে। মেধা থাকলেই যে মেধার বিকাশ ঘটবে, মেধা সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহূত হবে তার নিশ্চয়তা নেই।
এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে সাত লাখ ৩২ হাজার ৪৩১ শিক্ষার্থী। মাদ্রাসা বোর্ড থেকে সমমানের দাখিল পাস করেছে এক লাখ ৮১ হাজার ৪৩১ জন। কারিগরি স্তরে এসএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেছে ৬৪ হাজার ৫০১ জন। অর্থাৎ এবারই পাস করেছে প্রায় লাখ দশেক। এতে প্রমাণিত হয় আমরা শিক্ষিত জাতি।
শুধু শিক্ষিত নই। মহাজোট ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে বাঙালির যে মেধার মহাবিকাশ ঘটেছে তাও প্রমাণিত হলো। এবার এসএসসিতে এ-প্লাস পাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৮২ হাজার ৯৬১। শুধু এবারই নয়, বিশেষ বিশেষ সময় বিশেষ বিশেষ বছরে বাঙালির মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে। একবার ঘটেছিল ১৯৭২-৭৩ এ। একাত্তরের নয় মাস মানুষের পড়ালেখা করা তো দূরের কথা, থাকা-খাওয়ারই কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না, কিন্তু বাহাত্তরে দেখা গেল বাঙালির ছেলেমেয়েদের মেধা বঙ্কিমবাবুকে ছাড়িয়ে গেছে। ৯৮ শতাংশ পাস। তার মধ্যে প্রথম বিভাগের ছড়াছড়ি। হাজার বছরের মধ্যে বাহাত্তরেই বাঙালি মাথা তুলে দাঁড়াবার একটা সুযোগ পেয়েছিল, তখনই জাতির মেরুদণ্ডে মারা হলো সজোরে এক কোপ। সেই যে জাতি পঙ্গু হয়ে গেল আর যে হাজারখানেক বছরের মধ্যে উঠে দাঁড়াবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বেশি বেশি পাস করে, বেশি বেশি ভালো রেজাল্ট করে জাতি পঙ্গু হয় কীভাবে? ১৯৭২-৭৩ সালে যে মেধাবী শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগ পেয়েছিল তারই সঙ্গে অমেধাবী যে ভাগ্যবানও ফার্স্ট ডিভিশন ও চারটি লেটার নিয়ে পাস করে উভয়েরই মূল্য হয়ে যায় সমান। চাকরি-বাকরি বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে উভয়েরই দাম এক। অন্যকে দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে অথবা গাছতলাতে খাতা নিয়ে অঙ্কের স্যারকে দিয়ে লিখিয়ে যে ছাত্রটি বহু লেটারসহ পাস করেছিলেন, আজ তিনিই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোনো কলেজের অধ্যক্ষ অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব। সত্যিকারের মেধাবী ছেলে বা মেয়েটি যে নিজের চেষ্টায় পরীক্ষা দিয়ে তিন নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ পায়নি আজ সে কোনো সরকারি অফিসের বৃদ্ধ কেরানি। বাহাত্তরের অমেধাবী স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও শালীকে নিয়ে ৪২ লাখ টাকার গাড়িতে চড়েন। সেদিনের মেধাবী ছেলেটি পল্টন বা প্রেসক্লাবের সামনে প্রবল বর্ষণ অথবা কাঠফাটা রোদে শ্যামলীর বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেদিনের অমেধাবী আজ হয়তো কোনো দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূত, থাকেন প্রাসাদের মতো বাড়িতে। তাঁর সঙ্গের মেধাবী মিরপুরের কোনো গলির মধ্যে দুই কামরার সঙ্গে ছেলের বউ ও মেয়ে-জামাই নিয়ে থাকেন।
বাহাত্তরে যখন প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে তখন আমি ড. খুদার সহকারীর কাজ করতাম বিনা পয়সায়। শুধু তাঁর সাহচর্যটুকু ছিল আমার কাম্য। ড. খুদা এমনিতেই ছিলেন অতি মিতবাক, শিক্ষাজগতের অবস্থা দেখে তাঁর মতো শিক্ষাবিদ হতবাক হয়ে যান। পরবর্তীকালের শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানরা রাজার হালে থাকার সুযোগ পেয়েছেন; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ড. খুদা যেতেন কখনো রিকশায়। আমি তাঁকে আগলে বসে থাকতাম। জাতির শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল, শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের মেরুদণ্ড রিকশা থেকে পড়ে বুড়ো বয়সে ভেঙে গেলে সব শেষ। তিনি রিকশা-দুর্ঘটনায় পড়েননি বটে কিন্তু তাঁর প্রণীত কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশমালা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। তারপর জাফর-বাতেন কমিশন, মজিদ খান কমিশনসহ কত কমিশন হলো—শিক্ষার উন্নতি কিছু হলো না, বরং তা পরিণত হলো এক অনৈতিক ব্যবসায়। যে ব্যবসার উদ্যোক্তা বা এনট্রেপ্রেনার হলেন আমাদের একদল শিক্ষক।
অতি নিম্নমানের কিছ মূর্খগোছের মানুষ এককালে চাঁদা তুলে মাদ্রাসার ব্যবসা করত দুবেলা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য। চাঁদার বাক্স হাতে নিয়ে লম্বা কুর্তা পরে তারা হাটেবাজারে ঘুরত দু-চার পয়সার জন্য। মাদ্রাসা-ব্যবসা আগের মতো আছে, তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক সুবিধা। এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে বস্তা বস্তা টাকা আসছে। উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তৈরিতে মাদ্রাসার চেয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আর হয় না। তারপর শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন বাণিজ্য। এখন তা মাদ্রাসার মতোই ছড়িয়ে পড়েছে অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত। বাংলার শিশুদের এরা বারাক ওবামা বানিয়ে ছাড়বে। তবে তা বিনা পয়সায় নয়, বাবা-মায়েদের ফতুর করে। কিন্ডারগার্টেনের শিশুরা মাদ্রাসার তালবেলেমদের মতোই বাঙালি সংস্কৃতি থেকে সরে যাচ্ছে।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যটা আগে হতো না। তার শুরু আশির দশকে। এখন কেউ আর কোটি কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করবেন না। শ্রমিক অসন্তোষের ঝামেলায় পড়বেন না। কারও ছেলে বা জামাই যদি কোনো রকমে এমএ পাস হয়, তার পক্ষে একটা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অতি মামুলি ব্যাপার। কোনো পুঁজির প্রয়োজন নেই। কোনোভাবে একটা চার-পাঁচ কামরার বাড়ি ভাড়া করার সংগতি থাকলেই হলো এবং তাতে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেই হলো: অমুক ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অথবা ইস্টার্ন হার্ভার্ড বা সাউথ এশিয়ান অক্সফোর্ড। জমিজমা বিক্রি করে ছাত্রছাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোচিং সেন্টারও আধুনিক সংযোজন। একটি কোচিং সেন্টারের মালিকের যে আয় বাংলাদেশের কোনো পাটকল মালিকের আয় তার অর্ধেকও নয়।
সবচেয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এবার যারা পাস করেছে, তাদের ‘ভর্তি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। একাদশ শ্রেণীতে কোনো আসন-সংকট নেই। বরং যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে তার তুলনায় কলেজগুলোতে বহু আসন খালি থাকবে। ছাত্র-সংকটের কারণে অনেক কলেজ বন্ধ করার মতো পরিস্থিতিও রয়েছে।’ [সমকাল] তিনি আমাদের বন্ধু, ঘনিষ্ঠ এবং অতি সৎ ও সজ্জন। সুতরাং আমার কোনো মন্তব্য করার উপায় নেই।
আমরা দেশপ্রেম প্রকাশ করতে পাকিস্তান আমলের সবকিছুর নিন্দা করি। ১৯৬২ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার যে মান ছিল তা যেকোনো অগ্রসর কমনওয়েলথ দেশের সমমানের ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে বরং সাধারণ শিক্ষার মান ছিল নিচু। ১৯৬৩ থেকে শিক্ষার মান একটু নেমে গেল, কিন্তু তাও ছিল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। শিক্ষাকে বিশ্বমানসম্মত রাখতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেছে। সেই সব দলিলপত্র আমার কাছে আছে। এবারের শিক্ষা কমিটির কর্তাদের সেই সব দলিল দেখানোর জন্য একটি লোকের মাথায় দিয়ে অনেক ঘুরেছি। ওসবে চোখ বুলানোর সময় কারও নেই। তাঁরা ধা করে একটা রিপোর্ট পেশ করে দিলেন।
কোনো জাতির সন্তানদের মেধা বছরে বছরে ওঠানামা করে না। বাঙালির শিশু-কিশোরদের মেধা পৃথিবীর যেকোনো সভ্য জাতির শিশুদের মেধার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। অনুশীলনের মাধ্যমে সেই মেধার বিকাশ ঘটালে, তাদের যোগ্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা দেওয়া হলে, তারাও সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠবে। এখন যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করছে, আগামী দুই হাজার বিশের দশকে তারাই থাকবে দেশের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্বে। তাদের ভেতর থেকেই তৈরি হবে বিজ্ঞানী, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক, প্রকৌশলী, প্রশাসক, সমাজসেবক প্রভৃতি। প্রথম ১০ বছরে বঙ্কিমচন্দ্রসহ যে শখানেক শিক্ষার্থী প্রবেশিকা পাস করেছিলেন, তাঁরা যদি বঙ্গীয় সমাজে রেনেসাঁ আনতে পারেন, আজ লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী আরও বড় জাগরণ আনতে পারবে না কেন?
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.