জাতীয় সম্পদ-জামদানি শাড়ির ন্যায়বিচার by পাভেল পার্থ

সরকারের দায়িত্ব জামদানির ন্যায়বিচার সুরক্ষা করা। ভারতে বাংলাদেশি জামদানির শুল্কবিহীন বাজার প্রবেশাধিকারের বিষয়টি দ্রুত নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই। আশা করি বস্ত্র-ইতিহাসে সূক্ষ্মতম কাপড় মসলিনের এক অনন্য বংশধর বাংলাদেশের জামদানি শাড়ির ন্যায়বিচার সুরক্ষায় ভারত-বাংলাদেশ অচিরেই গড়ে তুলবে আন্তঃরাষ্ট্রিক সৌহার্দ্যের নজির


ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় সফরে অতিথিরা এলে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে যেসব স্মারক শুভেচ্ছা দেওয়া হয় তার ভেতর ইলিশ মাছ আর জামদানি শাড়ি প্রধান। চলতি সময়ে ভারতই বাংলাদেশের জামদানির অন্যতম ক্রেতা রাষ্ট্র। ২০০৭ সালে ভারত প্রতিটি জামদানি শাড়ির ওপর ৪ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ভারতে জামদানি রফতানি কমতে শুরু করেছে। ভারতের বাজারে জামদানি রফতানি করে বাংলাদেশ প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় করলেও চলতি সময়ে তা মাত্র ৭০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে (সমকাল, ১ মে ২০১২)। জামদানি শাড়ির ওপর ভারতের শুল্ক আরোপের পাশাপাশি বাংলাদেশও জামদানি রফতানির প্রণোদনা ২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। ঐতিহ্য, গুণগত মান, বুননশৈলী ও কাঁচামালের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি ভালো মানের জামদানি শাড়ি তৈরিতে প্রায় কয়েক মাস লেগে যায়। চলতি বাজারে ভালো মানের একটি জামদানির মূল্য প্রায় এক লাখ টাকা পড়ে যায়। কিন্তু ৪০ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের কোনো জামদানি শাড়ি ভারতীয় শুল্ক কর্তৃপক্ষ গ্রহণ না করায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাজারে জামদানি বিক্রি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দিনে দিনে দেশের ডেমরা-রূপসা জামদানি হাটগুলোও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। জামদানির ন্যায্য বাজার ও বাজারে প্রবেশের জটিলতার কারণে প্রতি বছর জামদানি কারিগররা ঐতিহ্যগত পেশা ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হচ্ছেন। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশের ৩০ হাজার জামদানি কারিগরের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজারে নেমে এসেছে (সমকাল, ১ মে ২০১২)। বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক ভৌগোলিক নির্দেশনা জামদানির এমন নিদারুণ যন্ত্রণার পেছনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। ২০০৭ সালে ভারত জাতিসংঘের 'বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা'র (ডবিল্গউআইপিও) কাছে জামদানিকে নিজেদের পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। ‘The Geographical Indications of Goods (Registration & Protection) Act, 1999’ (GI Act), ‘Geographical Indications of Goods (Registration and Protection) Rules, 2002 (GIRules এর মাধ্যমে ভারত এপ্রিল ২০০৪ থেকে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত যে ১১৭টি পণ্যকে নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত করেছে তার ভেতর বাংলাদেশের জামদানি শাড়িও একটি। আর জামদানি নিয়ে উৎপাদন ও বাণিজ্যের সমস্যাটি তৈরি হয়েছে এখান থেকেই। ভারত জামদানিকে একতরফাভাবে নিজেদের পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করায় বাংলাদেশের জামদানির ওপর অন্যায় শুল্ক ধার্য হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, জামদানি কাপড় আর কেবল কাপড় হিসেবে থাকছে না, তা বাংলাদেশ-ভারতের জন্য এক আন্তঃরাষ্ট্রিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করি, বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্র বাংলাদেশের জামদানির এ দুঃসহ যন্ত্রণা বোঝার চেষ্টা করবে এবং জামদানির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা সুরক্ষায় বাংলাদেশের সুবিচার নিশ্চিত করবে।
৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে জামদানিকে বাংলা ও পুণ্ড্র অঞ্চলের এক সূক্ষ্ম তাঁতবস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। চৌদ্দ শতকে পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশের সোনারগাঁ অঞ্চলের তাঁতের প্রশস্তি গেয়েছেন। ১৬ শতকের শেষ দিকে পর্যটক রালফ ফিৎচ এবং ইতিহাসবিদ আবুল ফজল তার 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে সোনারগাঁয়ের মসলিন তাঁতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। ১৮৮৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে মুসলমান ব্যবসায়ীরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, যাদের অনেকেই বাংলার জামদানি তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মূলত মোগল আমলেই জামদানির ব্যাপক প্রসার ও প্রচার হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা অঞ্চলকে ঘিরে সোনারগাঁ, ধামরাই, তিতাবাড়ী, জঙ্গলবাড়ী, বাজিতপুর এলাকাতেই জামদানি তাঁত শিল্প গড়ে ওঠে। ইউরোপ, ইরান, আর্মেনিয়াসহ মোগল-পাঠানরাও জামদানি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। জামদানির জনপ্রিয়তাকে দখল করে একক মুনাফা লুটতে ইংল্যান্ডেও একটা সময় যন্ত্রচালিত জামদানি কাপড় তৈরি করা শুরু হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের পূর্ব গোদাবরী জেলার উপ্পাদা কোথাপল্লী মণ্ডলের গ্রামের তাঁতি সমাজ, তাঁতিদের দুটি নিবন্ধিত সংগঠন এবং The Uppada Handloom Weavers Co-operative Production and Sales Society 2009 সালের জুলাই মাসে 'উপ্পাদা জামদানি' নামের জামদানি শাড়িকে তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করেছে। চেন্নাইয়ে অবস্থিত প্যাটেন্ট ও নিবন্ধন কার্যালয়ে কোথাপল্লী মণ্ডলের তাঁতিরা প্রায় বিশ বছর আগে জামদানি শাড়ির প্যাটেন্টের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। অন্ধ্রপ্রদেশের হস্তশিল্প হিসেবে জামদানি শাড়িকে 'উপ্পাদা জামদানি শাড়ি' নামে '১৯৯৯ সালের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধনকরণ আইনের' সেকশন-২(এফ) ধারার মাধ্যমে প্রশ্নহীন কায়দায় ভৌগোলিক নির্দেশনা হিসেবে নিবন্ধন করেছে ভারত (দরখাস্ত নম্বর-১২২)। অথচ এই জামদানি উপ্পাদা অঞ্চলের কোনো নিজস্ব লোকায়ত ভৌগোলিক পণ্য নয়। প্রায় তিনশ' বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশের পিথাপুরম, ভেংকটাগিরি এবং ববিলের মহারাজাদের মাধ্যমে উপ্পাদা অঞ্চলে জামদানি জাতীয় তাঁত বুননকে উৎসাহিত করা হয়। অন্ধ্রপ্রদেশের তাঁত নকশাবিদ ঘনশ্যাম সরোদ ১৯৮৮ সালে জামদানির এই ঐতিহ্যগত বুনন প্রক্রিয়াকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য উপ্পাদা অঞ্চলের তাঁতিদের দিয়ে আবারও নতুনভাবে জামদানি শাড়ি বোনা শুরু করান। পরবর্তীকালে বাণিজ্য স্বার্থ হাসিলের জন্য একে 'উপ্পাদা জামদানি' নামে পরিচয় করানো হয়।
জামদানি কাপড় বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক ভৌগোলিক নির্দেশনা। মূলত 'ঢাকাই' বা 'ঢাকাইয়া জামদানি' নামে পরিচিত জামদানি শাড়ির জন্মভূমি বাংলাদেশের শীতলক্ষ্যা নদীর অববাহিকা। দুনিয়ার সব ভূগোলে, সব যাপিতজীবনেই জামদানির মতো এ রকম বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক নির্দেশনা আছে। ইতালির পারমিগিয়ানো-রিগানিও পনির, ভারত-পাকিস্তানের বাসমতী চাল, ভেনিজুয়েলার চুয়াও কোকো, শ্রীলংকার সিলন চা, ভারতের দার্জিলিং চা, চীনের লং জিন চা, ফ্রান্সের শ্যাম্পেইন, কিউবার হাভানা চুরুট, তুরস্কের হেরেকি কার্পেট, মালয়েশিয়ার পাম তেল, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা ঘড়ি, বাংলাদেশের জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়ি পৃথিবীব্যাপী পরিচিত ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অসম বাণিজ্য চুক্তির ছুতোয় বাসমতী চাল, আলফন্সো আম এবং স্কচ হুইস্কির বাণিজ্যিক মালিকানা নিয়ে বিশ্বব্যাপী দেনদরবার শুরু হলে পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশনার প্রসঙ্গটি বাণিজ্য দুনিয়ায় আরেক ঝামেলা নিয়ে হাজির হয়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ২৩টি অসম ও অন্যায্য চুক্তিতেই বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, যার একটি হচ্ছে 'বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি' বা ট্রিপস। ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারায় দুনিয়ার সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর প্যাটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে, আবার ২২ ও ২৩ ধারায় ভৌগোলিকভাবে নির্দেশিত পণ্যের জন্য কিছু আইনগত স্বীকৃতির কথাও বলা হয়েছে। ট্রিপস চুক্তির ধারাকে মেনেই ভারত নিজস্ব 'সুই-জেনেরিস' আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যকে নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশনা হিসেবে নিবন্ধিত করছে। এভাবেই জামদানি, নকশি কাঁথা, ফজলি আমের ওপর রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর ফলে পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দরকষাকষি থেকে শুরু করে পণ্যের মেধাস্বত্ব মালিকানাও লাভ করবে ভারত। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের জামদানি তাঁত শিল্প এবং জামদানি কারিগরদের প্রথাগত জীবনের অধিকার। জামদানি রফতানি করতে গিয়ে যার ভোগান্তি বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পোহাতে শুরু করেছে।
সৃজন ও মননশীল শিল্পের মেধাস্বত্ব অধিকার সুরক্ষা বিষয়ে জাতিসংঘের Berne Convention for the Protection of Literary and Artistic Works (Paris Act 1971) ) নামক আন্তর্জাতিক সনদটির সমর্থক বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্রই। উভয় রাষ্ট্রই জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (সিবিডি ১৯৯২) স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে; যেখানে প্রাণসম্পদসহ লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষা অধিকারের প্রসঙ্গটি জোরালোভাবেই আছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের সুরক্ষার জন্য 'ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ ২০০৮' নামের একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছিল। এর তালিকায় জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব জামদানির ন্যায়বিচার সুরক্ষা করা। ভারতে বাংলাদেশি জামদানির শুল্কবিহীন বাজার প্রবেশাধিকারের বিষয়টি দ্রুত নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই। আশা করি বস্ত্র-ইতিহাসে সূক্ষ্মতম কাপড় মসলিনের এক অনন্য বংশধর বাংলাদেশের জামদানি শাড়ির ন্যায়বিচার সুরক্ষায় ভারত-বাংলাদেশ অচিরেই গড়ে তুলবে আন্তঃরাষ্ট্রিক সৌহার্দ্যের নজির।

পাভেল পার্থ : গবেষক
animistbangla@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.