পদ্মা সেতুর অর্থায়ন-বিশ্বব্যাংকের ঋণের জন্য চেষ্টা চালানো উচিত by এম রহমতউল্লাহ

বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়ক যোগাযোগ প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। দুটি সংযোগ সড়কসহ মোট দৈর্ঘ্য হবে ২৬ কিলোমিটার। ইতালিয়ান-থাই কোম্পানির সঙ্গে এ কাজের জন্য সরকার ২০০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করেছে। প্রকল্প ব্যয়ের সরকারি অংশ হবে ২৭ শতাংশ এবং ইতালিয়ান-থাই কোম্পানির ৭৩ শতাংশ। সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা


রয়েছে। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিনের জন্য ৫০ হাজার ডলার জরিমানা দেবে। ইতালিয়ান-থাই কোম্পানি এক্সপ্রেসওয়ের টোল থেকে তাদের বিনিয়োগ উসুল করবে এবং ২০৩৯ সালে এর মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের হাতে চলে আসবে।
বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে অবকাঠামো নির্মাণে এ প্রকল্পটি মডেল হিসেবে ধরা হচ্ছে। এটি সফলভাবে সমাপ্ত হলে এর ধারাবাহিকতায় আরও বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়। আলোচিত প্রকল্পটির জন্য আলোচনা চলে প্রায় দুই বছর। আগ্রহী কোম্পানিগুলো নিশ্চয়ই যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ ব্যয় ও টোল আদায়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে প্রতিদিন প্রাথমিক ধারণার চেয়েও বেশি মোটরযান চলছে। তারা নির্ধারিত হারে টোল প্রদান করছে এবং তা আদায়ে সমস্যা হচ্ছে না। এ সেতু দিয়ে মিটার ও ব্রডগেজ ট্রেনও চলাচল করছে। এ কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেতুর নির্মাণ ব্যয় উঠে আসতে পারে। এ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখেই সম্ভবত পদ্মা সেতু পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে নির্মাণের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে মাওয়া পয়েন্টে যে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ চলছে তার নির্মাণ ব্যয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে অনেক বেশি_ প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। এত বড় প্রকল্প নির্মাণের কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নেই। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থের জোগান দিতে চুক্তি সই করেও কিছু অভিযোগের কারণে তা ছাড় করা স্থগিত করেছে। এ কারণে অন্য যে কেউ_ সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পে অর্থ খাটাতে গিয়ে যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ করবে, তাতে সন্দেহ নেই। পদ্মা সেতু নির্মাণে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের যে ধারণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেছেন, তা ভালো। তবে আমরা চাইলেই রাতারাতি কোনো প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে বলে মনে করার কারণ নেই। বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধনের নিশ্চয়তা চায় এবং একই সঙ্গে চায় যথেষ্ট লাভ। প্রকল্প যেন দ্রুত লাভজনক হয়ে ওঠে, এটাও তাদের প্রত্যাশা থাকে। আস্থার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এক সরকারের অঙ্গীকার আরেক সরকারের সময়ে বদলে যায়_ এমন ঘটনা বাংলাদেশে রয়েছে। সরকারের বদল ঘটলেও প্রকল্পের কাজ থেমে থাকবে না এবং চুক্তিতে রদবদল ঘটবে না_ এ বিষয়টি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ডে এমনটি ঘটে না, ভারতেও না। ৩০০ কোটি টাকার একটি বিনিয়োগ প্রকল্প রাজনৈতিক কারণে বাতিল হবে না কিংবা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হবে না_ এ নিশ্চয়তা অবশ্যই চাওয়া হবে। আমার মনে হয়, মহাজোট সরকারের শুরুতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের উদ্যোগ নেওয়া হলে এ ধরনের প্রশ্ন আসত না। এক মেয়াদেই কাজ শেষ করে ফেলা যেত। এ উদ্যোগে সফলতা এলে শুধু পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন সহজ হতো না, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নেও উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া মিলত।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থের জোগান স্থগিত রাখায় অন্য দাতারাও 'দেখা যাক কী হয়' অবস্থান গ্রহণ করেছে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্বের প্রস্তাবে কেউ সাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সংশ্লিষ্টরা বিবেচনায় রাখবে, তাতে সন্দেহ নেই। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পরিবর্তন আনার পর সরকার বিশ্বব্যাংককে দ্রুত অর্থ ছাড় শুরুর অনুরোধ জানালে মনে হয় ভালো হতো। যত দূর জানা যায়, এ ধরনের চেষ্টাও শুরু হয়েছে। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত যোগাযোগমন্ত্রী এমন ধারণাও দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের ঋণের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেই কিন্তু বাংলাদেশ দ্বিতীয় সেতুর জন্য বিকল্প অর্থ-উৎস খুঁজতে পারে।

ড. এম রহমতউল্লাহ : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.