সহজ-সরল-আমার অশ্রুর দায় তো আমারই by কনক চাঁপা

মরা যখন চন্দ্রমলি্লকায় থাকি তখনকার গল্প। একদিন জানালায় চোখ মেলে দেখি অনেক দূরের ছাদে কী যেন নড়াচড়া করছে। ভালো করে দৃষ্টি দিয়ে বুঝি ওটা বাঁদর। আ রে? এই ঘনবসতি, গাছহীন ন্যাড়া ছাদে ওর কী কাজ? ওর মালিকের হাত ফস্কে এসেছে? এমন তো হওয়ার কথা নয়! ওয়ান-ইলেভেনের জরুরিঅবস্থাচলছে।রাজনীতিবিদদের ধরপাকড় চলছে। তাঁদের অনেক রাজকীয় অভ্যাসের একটা হলো বন্য জন্তু পোষা।


এই জরুরি অবস্থায় সেগুলো অন্যায় হিসেবে ধরা হচ্ছে বিধায় তাঁরা যার যার ব্যাঙ, মাকড়সা, সাপ, বাঁদর, সিংহ ছেড়ে দিচ্ছেন। এরই একটি বোধ হয় এই বাঁদর। আমার চিন্তা ও কী খায়? এ-ছাদে ও-ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে_মাথা চুলকাচ্ছে। সন্ধ্যার পর আর খুঁজে পেলাম না। পরদিন দেখি আরো কাছে একটা ছাদে পানির ট্যাংকির নিচে শুয়ে আছে। ওই ছাদে এক মহিলা আম শুকাতে দিয়েছেন, ওটা সে নেড়েচেড়ে দেখছে। তিনি বাঁদরকে দেখে ভয় পেয়ে আমটাম ফেলে একাকার। ট্যাংকির নিচে ছায়ায় বসে মাথা চুলকায়, নাক খোঁটে, খুব চিন্তা! ওকে প্রায় ২০টা কাক ছেঁকে ধরেছে। কাকগুলো কম বাঁদর নয় তো! এ লেজে ঠোকর দেয় তো ও দেয় কানে ঠোকর। যন্ত্রণা ঠেকাতে বাঁদর একটা লাঠি হাতে নিয়েছে। লাঠিটা কাকের উদ্দেশে উদাসভঙ্গিতে নাড়ায়। ঘরে কলা ছিল। ভাগ্নে সোহাগকে বললাম, বাবা, টার্গেট প্র্যাকটিস কর_কলা ছুড়ে মার। এক বিল্ডিং থেকে অন্য ছাদে কলা ছোড়া সোজা নয়। তবুও তিনটি কলা ওর সামনে পড়ল। নিমিষেই সে খেয়ে ফেলল_ওর অনেক ক্ষুধা। আমিও কলা ছুড়লাম, যথারীতি ভুল জায়গায় পড়ল। এ ছাড়া আর কী হবে। পরদিন দেখি অন্য ছাদে। একটা দুষ্ট লোক পেছন থেকে আস্ত ইট তুলেছে মারবে। ইট মারার আগেই বাঁদর ছুটে পালাল। মনে হলো লোকটাকে একটা ঢিল ছুড়ি। মানুষ এমন হয়? হয়। মানুষই বেশি পশু-পশু হয়। পরদিন দেখি একটা রান্নাঘরে ঢুকে কী যেন চুরি করে খাচ্ছে। করবেই তো, ক্ষুধা লেগেছে না? ওকে তো আর কেউ দাওয়াত করছে না। এর পরদিন দেখি অন্য একটা চিলেকোঠায়_খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে। মনে হয়, মালিকের কথা, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করছে। খেতে পাচ্ছে না, কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে। আমি অস্থির, এত বড় একটা প্রাণী চোখের সামনে মরে যাবে? মইনুলকে বললাম। সে বলে, 'আমি কী করব!' আমার চিন্তা, কেউ যদি মেরে ফেলে? আবার মইনুলকে জ্বালাতন। শেষে ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ফোন দিল। তারা চিড়িয়াখানার ফোন নম্বর দিল। সেখানে ফোন করা হলো। তাঁরা বলেন, 'আমাদের কী করার আছে?' আমার একরোখা জিদের কারণে মইনুলও নাছোড়বান্দা। একটা পশু নিরাপত্তাহীনতা, খাদ্যহীনতায় ভুগছে, আপনাদের দায়িত্ব নেই মানে! পেপারে লিখে দেব কিন্তু! টনক নড়ে চিড়িয়াখানার। কর্তৃপক্ষ না বলে চিড়িয়াখানা বললাম এ জন্য যে যারা শিয়াল-বাঁদরের খাবার মেরে দেয় তারা ওই চিড়িয়াখানার অনেক খাঁচার দাবিদার। তারা বলল, জাল-বন্দুক-বেড়ি নিয়ে আসতে আসতে বিকেল হবে। তা-ই সই। বাঁদরটা বাংলালিংকের একটা অ্যান্টেনার গোড়ায় বসে আছে। মূর্তি হয়ে। সন্ধ্যা হয়ে এল। ওকে দেখা যায় কি যায় না। ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তেনারা এলে মইনুল গেল ওকে দেখিয়ে দিতে। বাসায় ফিরল রাত ১০টায়। কী হলো? নাকাড়া-নাকাড়া দুন্দভি ঢাক নিয়ে ওকে ধরতে গেলে সে অনায়াসে ছয় তলার ছাদ থেকে পালিয়েছে। কেউ আর খুঁজে পায়নি। নিধিরাম সর্দাররা অদ্ভুত মিশন থেকে গজ গজ করতে করতে বাঁদরকে গালাগাল করে (হয়তো বা আমাকেই) ফেরত গেছে। আর আমি? আমার চোখ জলে ভিজলে তার দায় তো আমারই নাকি? আমি কি ওই বাঁদরেরও মা? এখনো আমি এ-ছাদ ও-ছাদ তাকাই যদি ওকে দেখা যায়? আ রে, এটা কখনো হয় যে জনাকীর্ণ এলাকায় বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে বাঁদর আমাকে দেখা দিতে আসবে! বোকা মেয়ে কোথাকার!

লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.