কানাডাপ্রবাসীদের খেদ by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

মৎকার কাটল মাসাধিককাল কানাডার টরন্টোয়। দিনগুলো আরো উপভোগ্য হতো, যদি না কিছু নেতিবাচক ঘটনা পর পর ঘটে যেত! ঘটনাগুলো ঘটল যেন একটার পিঠে একটা। সবই দেশের ভাবমূর্তির মারাত্মক সংহারক। কানাডায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখেছি, ঘটনাপরম্পরায় শুধু লজ্জিত হতে নয়, ক্ষুব্ধ হতেও। কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের রাজধানী শহর টরন্টোয় প্রচুর বাংলাদেশির বসবাস। শহরের একটি এলাকা তো রীতিমতো বাঙালিপাড়ার মতো।


রাস্তাঘাট, দোকানপাট, শপিং মল_যেখানে যাওয়া যায়, কানে ভেসে আসবে বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণে বাংলা কথোপকথন। স্কারবোরোর ড্যানফোর্থকে লিটল বাংলাদেশ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এখানকার এক মুদি দোকান থেকে যে সাইজের ও ওজনের ইলিশ মাছ কেনা হয়, একদিন তেমন ইলিশ চাঁদপুর, ইলিশের জন্য যার খ্যাতি, সেই স্থানেও খুব কমই দেখেছি। চাঁদপুরের সেরা মাছগুলো বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায় বলেই ইলিশের দেশে ভালো ইলিশ আক্রা।
আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, রোজার মাঝামাঝি যখন টরন্টোয় পেঁৗছি, চমৎকার শরতের আবহাওয়ায় উজ্জ্বল দেশটি প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শশব্যস্ত জীবনের বিপরীতে এক ধরনের ঢিলেঢালা আয়েশি ভাব আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যখন আত্মজার বাসায় আসছি, রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। বাম্পার-টু-বাম্পার ট্রাফিক, যেকোনো মেট্রোপলিটন সিটির বিকেলবেলার নিয়মিত দৃশ্য। টরন্টোয় এর ব্যত্যয় হলো না। তবে তেমন তাড়াহুড়া নেই গাড়িচালকদের মধ্যে। একসময় নজরে পড়ল কানাডা ন্যাশনাল টাওয়ার_সিএন টাওয়ার, যাকে বলা হয় কানাডার ল্যান্ডমার্ক। সগর্বে যেন আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা টরন্টো ডাউনটাউনের এই সুউচ্চ টাওয়ারটি কানাডাবাসীর গর্বের প্রতীকও। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, কানাডা ও নায়াগ্রা জলপ্রপাত সমার্থক। নায়াগ্রা দেখে প্রথমে যে অনুভূতি হয়, তা বর্ণনা করা সাধ্যাতীত। কোনো কলমে সম্ভব নয় এর বর্ণনা, কোনো তুলির সাধ্য নয় এর ছবি আঁকা। আর নিসর্গে তো সবুজের ছোঁয়া আছেই। এর সঙ্গে রয়েছে নানা বর্ণের, নানা রঙের ফুল। কানাডার জাতীয় বৃক্ষ ম্যাপলগাছে সবুজ পাতার আবাহন। অটামে কী চমৎকার সবুজ রং লেগেছে পাতায় পাতায়! অটাম শেষে ফল এলে পাতা হয়ে উঠবে লালাভ। আর শীতে তো রিক্ত প্রকৃতি, সম্পূর্ণ বিষণ্নতার মোড়কে ঢাকা পড়ে যাবে। কানাডার শীত উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে নির্মম শীত_ক্রুয়েল উইন্টার। মেরু অঞ্চলের নৈকট্যের কারণে।
তবে এবার শীতের আগেই কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে নেমে আসে এক ধরনের বিষণ্নতা ও গ্লানিবোধ। যাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁর মধ্যেই দেখেছি এক ধরনের হতাশা। দেশের যা কিছু ভাবমূর্তি অবশিষ্ট ছিল, তাও শূন্যে মিলিয়ে যেতে বসেছে, অন্তত কানাডা ও কানাডাবাসীর কাছে তো বটেই।
প্রথম মন খারাপ করা দুঃসংবাদটি পাওয়া গেল আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। প্রভাবশালী দৈনিক 'টরন্টো স্টার'সহ অন্যান্য দৈনিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয় বাংলাদেশি এক ইমামের গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ। ইমাম সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যৌন হয়রানির অভিযোগে, যা একজন ধর্মীয় নেতার জন্য অত্যন্ত আপত্তিকর ও অবিশ্বাস্য। ৪৮ বছর বয়সী ইমামের বিরুদ্ধে ১৩ দফা অভিযোগ এনেছে টরন্টো পুলিশ। বলা হয়েছে, এসব অপরাধ তিনি করেছেন ১ নভেম্বর ২০০৮ থেকে ২৮ জুলাই ২০১১-এর মধ্যে। ১০ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ক্যালগারিতে এবং পরে তাঁকে আনা হয় টরন্টোতে। ইমাম সাহেব টরন্টোর বাঙালিপাড়ায় এক নামকরা মসজিদে ২০০৮ সাল থেকে ইমামতি করে আসছিলেন। ইমাম সাহেব এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, মিশিগান এবং এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আর স্বদেশে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর গ্রেপ্তারের কয়েক দিন পরই অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল ফিতর। খবরটি শোনার পর সমবেত মুসলি্লদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকেই খরবটি বিশ্বাস করতে পারেননি। কারো কারো মতে, মসজিদ কমিটির মধ্যে বিদ্যমান দলাদলির শিকার হয়েছেন ইমাম সাহেব। অন্যরা অবশ্য তেমনটা মনে করেন না।
টরন্টো পুলিশের ধারণা, ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে আরো তথ্যপ্রমাণ তারা তাঁর পূর্ববর্তী কর্মস্থল থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। পুলিশ আশ্বস্ত করে বলেছে, ধর্মীয় কারণে ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ইমাম গ্রেপ্তারের ধুলো স্থির হয়ে বসার আগেই পাওয়া গেল আরেকটি দুঃসংবাদ। বাংলাদেশ সরকারের তথা বাংলাদেশের স্বপ্নের প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান কানাডার এসএনসি-লাভালিন। গ্রুপ ইনকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশ তাদের দপ্তরে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির অভিযোগের পর কানাডার পুলিশ এই ব্যবস্থা নিল। বিশ্বের ১০টি বড় প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের অন্যতম এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে এর আগেও ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে ভারতের কেরালার কেবল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের একটি কাজেও অনুরূপ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ফলে বেশ কয়েকজন রাজনীতিক, মন্ত্রী, আমলাও শাস্তি পেয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ ব্যক্তিরা যতই বলুন না কেন, এখন পর্যন্ত এসএনসি-লাভালিনকে চুক্তিবদ্ধ করা হয়নি। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন যেটুকু হওয়ার দেশটির, ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এবং অনিবার্যভাবে 'স্বপ্নের সেতু' নির্মাণের স্বপ্ন আরো দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য। দুঃসংবাদের পাল্লা বোধ হয় তখনো ভারী হতে বাকি ছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর টরন্টো স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ লিড নিউজ হিসেবে এক বাংলাদেশির 'কীর্তির' কথা ছাপা হলো : 'প্রপার্টি ম্যানেজার বিল্ক্ড্ ২০ মিলিয়ন ডলার ইন কনডো ফ্রড, ভিকটিমস ক্লেইম' শিরোনামে। ২০ মিলিয়ন আইনজীবীরা হিসাব করে দেখলেন দুই কোটি ডলার। হাতিয়ে নিয়ে কানাডা ছেড়েছেন বাংলাদেশের এই 'কীর্তিমান'। তাঁর নাম মনজুর মোরশেদ খান। চ্যানেল প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট নামের একটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে পাঁচটি বড় ভবনের এক হাজার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির নামে এই বিশাল অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন তিনি। টরন্টোর অভিজাত উডব্রিজ এলাকায় অত্যাধুনিক অফিস ভবনে বসে দিনের পর দিন তিনি অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির নামে সরল গ্রাহকদের প্রতারণা করে চলছিলেন। তাঁর গ্রাহকদের মধ্যে বাংলাদেশি ও কানাডীয় রয়েছেন।
কানাডার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতাদের মতে, এমন অভিনব ও অভিজাত উপায়ে প্রতারণার ঘটনা দেশটিতে আগে আর ঘটেনি। এই ব্যক্তি সম্পর্কে যেসব খবর এখন পাওয়া যায়, তাতে অনায়াসে তাঁকে চলচ্চিত্রের চরিত্র সাধু শয়তান হিসেবে অভিহিত করা যায়। শোনা যায়, এই ব্যক্তি বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। এবং দেশেও নাকি তাঁর অতীত রেকর্ড রয়েছে প্রতারণার। একের পর এক নেতিবাচক খবরে কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে হতাশার যে ছবি দেখেছি, তা ভোলার নয়। তাঁরা কোনো রকম ব্যাকল্যাশ আশঙ্কা করেন না। তবে ইমেজ সংকট যে তাঁদের প্রতিনিয়ত তাড়া করবে, তা তো একরকম নিশ্চিতই!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক


No comments

Powered by Blogger.