মানবতাবাদী দার্শনিক রমেন ঘোষ by শিশির কুমার ভট্টাচার্য

থাটি আমার নয়। কথাটি বলেছিলেন স্বয়ং বদরুদ্দীন উমর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ডক্টর রমেন্দ্রনাথ ঘোষ গত ২৫ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যথার্থই রমেন ঘোষ ছিলেন একজন সভ্য সুশিক্ষিত সুপণ্ডিত। তাঁর মৃত্যুতে পৃথিবী এক সুসন্তানকে হারাল। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পরই রমেন ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হই। সেই পরিচয় থেকে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা।


রমেন ঘোষ হয়ে গেলেন আমাদের রমেনদা। সুখে-দুঃখে আমরা এই দুটি পরিবার একই সঙ্গে থাকতাম। আমি অনেকভাবে এই পরিবারটির কাছে ঋণী। একটি দিনের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। একাত্তরের ২ এপ্রিল। রাজশাহীতে বোম্বিং হচ্ছে। আগের দিন শহরে অপারেশন হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ক্যাম্পাসে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে পড়তে পারে ভয়ে সবাই পালাচ্ছে। আমার বন্ধুরা যে যার মতো ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে। আমি কিছুই জানি না। ফ্ল্যাটেই ছিলাম। সঙ্গে আমার ছোট ভাই। হঠাৎ রমেনদা ডাকলেন, এক্ষুনি ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে হবে। কোথায় যাব ভাবছি। রমেনদা কিছু না শুনে আমাদের নিয়ে চললেন বর্ডারের দিকে। চলে গেলাম ভারতে। সেদিন যদি রমেন পরিবারও আমাদের ফেলে চলে যেত, তাহলে শহীদের সংখ্যা হয়তো আরো দুুুজন বাড়ত।
রমেন ঘোষ ছিলেন দর্শনশাস্ত্রের সুপণ্ডিত তাঁর পাণ্ডিত্যের মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি দেখেছি যে দর্শনের যেকোনো বিষয় নিয়ে যেকোনো সময়ে তিনি আলোচনায় অংশ নিতে পারতেন। আমার কাছে মনে হতো তিনি যেন দর্শনশাস্ত্রের এক মূর্তিমান এনসাইক্লোপিডিয়া। দার্শনিকরা তো সত্যকে খুঁজে থাকেন। কিন্তু সত্যের সন্ধান তাঁরা আজও দিতে পারেননি। রমেন ঘোষও দর্শনের সব শাখা চষে বেড়িয়েও পরম সত্যকে খুঁজে পাননি। বিজ্ঞানীরা কিন্তু একটি সত্যকে পরম বলে গ্রহণ করেছেন। বিজ্ঞানের পরম সত্য ছিল এই যে 'পরম সত্য বলে কিছু নাই, সবই আপেক্ষিক।' আইনস্টাইন গতির ক্ষেত্রে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রফেসর রমেন্দ্র ঘোষের সঠিক মূল্যায়ন আমরা করিনি বা করতে পারিনি। কিন্তু বাইরের দর্শনবিশারদদের কাছে তাঁর কদর ছিল। বাংলাদেশের জি.সি দেব, ভারতের শিবজীবন ভট্টাচার্য এবং অঙ্ফোর্ডের প্রফেসর মতিলালের মতো ব্যক্তিত্বদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। একবার ভিজিটিং ফেলো হিসেবে তিনি কিছুদিন অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে এসেছেন। সেখানেও তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। পাশ্চাত্যের দেশে পণ্ডিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ পাওয়া একটি সম্মানের ব্যাপার। কেননা লাঞ্চ মানে তো শুধু খাওয়া নয়। তার সঙ্গে চলে একাডেমিক আলোচনা। রমেন ঘোষ কিন্তু অঙ্ফোর্ডের বিখ্যাত প্রফেসরদের কাছ থেকে একাধিকবার লাঞ্চের নিমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং তাঁদের সঙ্গে দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছেন। রমেন ঘোষ প্রকৃত অর্থে সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কিন্তু বিনিময়ে দর্শন বিভাগ তাঁকে কতটুকু স্বীকৃতি দিয়েছে? রমেনদার মনে একটা ক্ষোভ ছিল যে বিভাগে তিনি উপেক্ষিত। তাঁর স্মরণসভায় দর্শন বিভাগের বক্তারা সবাই তাঁর পাণ্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতো মহাপণ্ডিত নাকি আগামী ১০০ বছরেও দর্শন বিভাগে আর আসবে না। কেউ কেউ আবার বলেছেন, ১০০ বছর কেন, কোনোকালেই দর্শন বিভাগ এমন পণ্ডিত ব্যক্তি পাবে না। রমেনদা যদি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর সম্পর্কে বিভাগীয় এই মূল্যায়নের কথা জেনে যেতে পারতেন, তাহলে তিনি কত না খুশি হতেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিভাগের সবাই যদি জানেন যে রমেন্দ্রনাথ ঘোষ একজন মহাপণ্ডিত, তাহলে তাঁর অবসর গ্রহণের পর তাঁকে বিভাগের সঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য কেউ কোনো উদ্যোগ নিলেন না কেন? ইমেরিটাস প্রফেসর কিংবা নিজের পক্ষে অনারারি প্রফেসর হিসেবেও বিভাগের সঙ্গে যুক্ত রাখা যেত। তাতে রমেন ঘোষকে সম্মানিত করা হতো না। সম্মানিত হতো বিভাগ।
রমেনদা ছিলেন একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। কিন্তু পারিবারিক জীবনে ছিলেন সনাতনপন্থী। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তিনি চলতেন। সাংস্কৃতি পরিচয়ে তিনি ছিলেন ঘোর বাঙালি। জন্মভূমির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল অতি গভীর। এই আকর্ষণই তাঁকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনে নিয়ে এসেছিল। একাত্তরে রমেনদা বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এই নিয়োগ ছিল প্রকৃতপক্ষে একজন শরণার্থী শিক্ষাবিদকে সাহায্য করে। রমেন ঘোষ সেখানে শুধু শিক্ষকতাই করেননি, বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতাও করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রমেনদা ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এমন সময় বিভাগীয় প্রধান ড. জারবেকার রমেনদাকে প্রস্তাব দিলেন বরোদায় থেকে যাওয়ার জন্য। রমেনদা তখনো পিএইচডি করেননি। কাজেই রমেনদার কাছে এ এক মহাসুযোগ। পিএইচডি করা। একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা, ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে সংখ্যাগুরুর মর্যাদা পাওয়া ইত্যাদি প্রলোভন। কিন্তু রমেনদা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে মাটির টানে দেশে চলে এলেন। সংখ্যাগুরু হওয়ার পরিবর্তে সংখ্যালঘু হওয়ার মধ্যেই তিনি প্রকৃত শান্তি খুঁজে পেলেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.