হেমন্তেই ঘন কুয়াশা by রাশেদ মেহেদী

লবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যখন দুনিয়াজুড়ে হৈচৈ চলছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছুটে গিয়ে পরিবেশবাদীরা দেন-দরবার করছেন, তখন বাংলাদেশের আবহাওয়ার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়েও অনেকটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। গেল বছর শীত পড়েছিল জানুয়ারির শুরুতে। কুয়াশায় দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। এবার কাঁপুনি দেওয়া শীত ও ঘন কুয়াশা এসেছে ডিসেম্বরের শুরুতেই।


বাংলা বর্ষ অনুযায়ী অগ্রহায়ণ শেষ হতে এখনও দু'দিন বাকি। পৌষের সোনা রোদমাখা দিনের হিসাব এখনও শুরু হয়নি। পরিবেশবিদরা বলছেন, ঋতু পরিবর্তন আর আবহাওয়ার খেয়ালি চরিত্র ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের সতর্ক সংকেত। জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ এতটাই স্পষ্ট যে, বছর বছর সময় বদলে যাচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের। এর ফলে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ছেন কৃষক। গ্রামের অধিকাংশ কৃষক এখনও বীজতলা তৈরি করেন
শীত-গ্রীষ্মের হিসাব করে, বাদল দিন আর রোদেলা দিনের দিকে তাকিয়ে। আবহাওয়ার গোলমেলে চরিত্রের কারণে তাদের বীজ বপন, চারা রোপণ নিয়েও পড়ছেন মহামুশকিলে। লোপ পাচ্ছে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর ঋতুভেদে অভিযোজন ক্ষমতাও। ঢাকা আবহাওয়া অফিসের কর্তাবক্তিরা অবশ্য বলছেন, পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে সৃষ্ট গাঢ় মেঘ ঝরে পড়ছে অসময়ের ঘন কুয়াশা হয়ে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার গত দেড় যুগের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছিল ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৭ সালে দেশের তাপমাত্র ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠেকেছিল। জানুয়ারি মাসে ১১ দিন স্থায়ী শৈত্যপ্রবাহ ছিল। পরের বছর ১৯৯৮ সালেও জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সাত-আট দিনের শৈত্যপ্রবাহসহ খোদ রাজধানীর তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গিয়েছিল। আর ওই বছর থেকেই শীতকালের শুরুর সময় পিছিয়ে যায়। এর আগে অগ্রহায়ণের শেষে শীত-শীত ভাব অনুভূত হতো। পৌষ মাসে দেখা যেত শিশির ধোয়া সকাল, মাঘে শীত পড়ত জাঁকিয়ে। মাঘের শেষে কম-বেশি এক সপ্তাহের একটা শৈত্যপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বিদায় নিত শীত। কিন্তু ১৯৯৮ সালের পর থেকে গত বছর পর্যন্ত অগ্রহায়ণ, এমনকি পৌষেও শীতের ভাবটা খুব একটা গায়ে লাগেনি। শীতের শুরুর সময়টা অনেকটা স্থির হয়ে গিয়েছিল ডিসেম্বরের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে থেকে পুরো জানুয়ারি মাস। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও শীতের কাপড় গা থেকে নামানো যেত না। ২০০৬ সালের জানুয়ারির শুরুতে এবং ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে বঙ্গোপসাগরে দুটি নিম্নচাপ আর তার প্রভাবে দেশজুড়ে ঝড়ো হাওয়া ও প্রবল বৃষ্টিপাতের ঘটনাও ভাবিয়ে তুলেছিল আবহাওয়াবিদ আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা পরিবেশবিদদের। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের সেই নিম্নচাপের পর ধেয়ে এসেছিল শৈত্যপ্রবাহ। ফাঁকা মাঠের দূরগ্রাম তো বটেই, কংক্রিটের আবরণে ঢাকা ভ্যাপসা গরমের রাজধানীর জীবনযাত্রাও প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল সেবারের দু'দফা শৈত্যপ্রবাহে। পরের বছর ২০০৮ সালেও ঘন কুয়াশা আর বাঘ কাঁপানো শীতের দাপট ছিল পৌষের মাঝামাঝিতে, ডিসেম্বরের শেষে। মাঝখানে ২০০৯ আর ২০১০ সালে শীতের মাতামাতি আবার সেই জানুয়ারিতেই।
এবার আবার আবহাওয়ার চরিত্র বদল। অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই বাতাসে হিম। অগ্রহায়ণ শেষ হওয়ার আগেই নামল ঘন কুয়াশা। ঝক্কি-ঝামেলা আরও আছে। ভোরে গায়ে ভারী চাদর জড়াতে হলেও দুপুরে দিব্যি গরম। সন্ধ্যা পার হতে না হতেই গরম কাপড় ছাড়া চলা যায় না।
ঢাকা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ রোববার সমকালকে বলেন, এ সময়ের আবহাওয়ার এ গোলমেলে স্বভাবটা এসেছে পশ্চিমের লঘুচাপ থেকে। স্থলভাগে সৃষ্ট এ লঘুচাপের কারণে সৃষ্টি হয়েছে গাঢ় মেঘ। আর সেই মেঘ মৃদু হাওয়ায় ভেসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার থেকে উড়ে এসে বাংলাদেশের মাটিতে ঝরে পড়ছে ভোরের ঘন কুয়াশা হয়ে। লঘুচাপের প্রভাব এর মধ্যেই কমে গেছে, গাঢ় মেঘের আস্তরও ফিকে হয়ে গেছে। দু'এক দিনেই অসময়ের কুয়াশা উবে গিয়ে পৌষের মিষ্টি রোদেলা সকাল ফিরে আসবে। তার অভিমত, হেমন্তের কুয়াশা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ ঘন কুয়াশা আর সকালে রাতের তাপমাত্রা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও দিনের গড় তাপমাত্রা এখনও ১৭ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তিনি জানান, ঘন কুয়াশা উবে যাওয়ার পর শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকবে। দিনের গড় তাপমাত্রা ১৪ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ এলেও আসতে পারে।
ঢাকা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদদের এ হিসাব সরল চোখে দেখছেন না বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নেতা স্থপতি ইকবাল হাবীব। তিনি বলেন, আবহাওয়ার এ খেয়ালি চরিত্র জলবায়ু পরিবর্তনকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আরও বড় বিপর্যয়ের সতর্ক সংকেত এগুলো। একবার শীত আসছে মাঘের শেষে, আরেকবার অগ্রহায়ণের শেষে। এটি কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। যেহেতু এখনও বাংলাদেশের কৃষক ঋতু পরিবর্তনের সময় হিসাব করেই তাদের চাষবাসের দিনপঞ্জি ঠিক করেন, সে কারণে বছর বছর ঋতু পরিবর্তনের সময় পাল্টালে কৃষকের দুশ্চিন্তা বাড়ে, বীজতলা কখন ঠিক হবে তা নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়তে হয়, প্রভাব পড়ে নিট ফসল উৎপাদনেও। আবার ঋতুভেদে প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের যে স্বাভাবিক অভিযোজন ক্ষমতা সেটাও লোপ পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের আরও বড় ধাক্কা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.