চিন্ময় আর ঘড়েখান, কার্ল এ এফ ইন্ডারফার্থ-বন সম্মেলন থেকে কাবুলের যা শোনার প্রত্যাশা ছিল

নে আয়োজন করা হয়েছিল ৮৫টি দেশের বিশাল সম্মেলনের। এমনই আরেকটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ হয়েছিল ১০ বছর আগে তালেবান সরকার উৎখাতের পরামর্শের জন্য। আফগানিস্তানে সফল অর্জন হয়েছে, তারই স্মরণ অনুষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় এই সভাকে। আজকে ১০ বছর পর মূল্যায়নের সময় এসেছে, আফগানিস্তান সত্যিকার অর্থে কোথায় এসে পেঁৗছেছে। উন্নয়ন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার


প্রচেষ্টা_সবই আলোচনায় আসা উচিত। আর ২০১১ সালের বন-২ সম্মেলন হিসেবে তাই একে আখ্যায়িত করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনাদের আফগানিস্তান ত্যাগের পরবর্তী দশকে আফগানিস্তানের কী পরিস্থিতি হবে, তা দেখা উচিত। আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য কোন ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা প্রয়োজন হবে, তাও দেখতে হবে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান ছেড়ে যায়, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে সেই প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন করেনি। বন-২ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বন চুক্তি ২০০১-এর কথা স্মরণ করা উচিত। তার আগে আফগানিস্তানের সব মহলের তরফ থেকেই জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল, যাতে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহযোগিতা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে আসে। কোনো বৈদেশিক শক্তি যাতে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলায়, তারও নিশ্চয়তা কামনা করেছিল তখন।
আফগানিস্তানের বিবদমান গ্রুপগুলোর সবাই জানে যে তাদের মধ্যে যে অনৈক্য, বিভাজন ও হানাহানি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে বৈদেশিক শক্তির ন্যক্কারজনক উলঙ্গ হস্তক্ষেপ। অন্য দেশকেও অস্থিতিশীল করার কাজে যেন কেউ আফগানিস্তানকে ব্যবহার করতে না পারে, সেই নিশ্চয়তাও দিতে হবে।
এই সম্মেলনের আগে এশিয়ার হৃৎপিণ্ডখ্যাত আরেকটি বৈঠক হয়েছিল ইস্তাম্বুলে। সেখানে আফগানিস্তান ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, ইরান, সৌদি আরব, চীন থেকে রাশিয়ার অংশগ্রহণ ছিল। ওই সম্মেলন থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে যে আফগানিস্তানের গ্রুপগুলো যদি একা একা চলার চেষ্টা অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তখন কিন্তু বৈদেশিক শক্তিগুলো তাদের পছন্দসই গ্রুপগুলোকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে থাকবে। আর এর পরিণতিতে আফগানিস্তানকেই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাদের গৃহযুদ্ধ তীব্রতর হবে এবং অস্থিতিশীলতা দূর হওয়ার কোনো লক্ষণই থাকবে না। সম্মেলনের ফলটা কী হয়েছিল? এই সম্মেলনের প্রাপ্তিকে 'ইস্তাম্বুল প্রসেস' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ইস্তাম্বুল ঘোষণা বলার সুযোগও যেন ছিল না। এই যে ঘটনা, তাতে কিন্তু আরেকটি বিষয় স্পষ্ট প্রকাশ হয়ে পড়ে যে আফগানিস্তানের ব্যাপারে বৈদেশিক শক্তির নাক না গলানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জোরালো হয়। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে এর বিকল্প কী? আর বৈদেশিক শক্তিগুলোর প্রতিশ্রুতিও তো ছিল তেমনই। আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক একটা নীতিমালা প্রণয়নও প্রয়োজন এই পরিপ্রেক্ষিতে, যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত, মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ।
তবে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ না করার কারণে এই আঞ্চলিক সমঝোতা কিংবা চুক্তিজাতীয় কিছু করাটা যে অনেক দূর পিছিয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে বলে নেওয়া ভালো, সম্প্রতি পাকিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর হাতে ২৪ পাকিস্তানি সেনার মৃত্যু হওয়ায় পাকিস্তান তাদের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এ সম্মেলনে যোগ দেয়নি। পাকিস্তানকে সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো দেশ যদি ভূমিকা রাখত তাহলে এই সম্মেলন ফলদায়ক হতো।
মনে রাখা প্রয়োজন, ইস্তাম্বুলে গৃহীত 'ইস্তাম্বুল প্রসেস' আফগানিস্তান সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ইস্তাম্বুল প্রসেস স্বাক্ষরকারী ১৩টি দেশকে যুক্ত করতে হবে কঠিনভাবে। তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য একটি পর্যবেক্ষক গ্রুপ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে চুক্তি কিংবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো রদ করা হলে তার জন্যই বা কী করা হবে। সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী জাতীয় কোনো বাহিনী কি কাজ করবে? এমন প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে বের করতে হবে।
বাইরের কোনো দেশের পক্ষে কি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে? এমন বেশ কিছু সীমান্ত আছে যা হয়তো এখনো মীমাংসার অপেক্ষায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশেরই তো এগিয়ে আসতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে ছাড়া কি কিছু হতে পারে?
বলা যায়, এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কৌশল হিসেবে সেখানে ইস্তাম্বুল প্রসেসকে সামনে আনতে পারে জাতিসংঘ। আর তাদেরই শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রযুক্তিসুবিধা রয়েছে। বিবদমান গোত্রগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্যও জাতিসংঘ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা সেখানে সালিসকারীর অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আফগানিস্তান এ মুহূর্তে আরেকটি কাজ করতে পারে। তারা জাতীয়ভাবে একটি মহাসম্মেলন আহ্বান করতে পারে। যাকে তারা 'জিরগা' বলে আখ্যায়িত করে থাকে। সেই 'জিরগা'র মাধ্যমে নিশ্চয়ই কোনো সুফল আসতে পারে। আফগানিস্তান এখন আর অন্য কারো খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায় না। এখন যে মাঠটি আছে তাও বন্ধ করে দিতে চায় তারা।
লেখক : চিন্ময় আর ঘড়েখান ছিলেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং কার্ল এ এফ ইন্ডারফার্থ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.