বিকল্প অর্থায়ন কোত্থেকে by আবু কাওসার ও শরীফুল ইসলাম

দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পে টাকা ছাড় করবে না বিশ্বব্যাংক। কবে এ টাকা পাওয়া যাবে তা এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণ সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প। তাই বিলম্ব না করে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করতে চায় সরকার। এক্ষেত্রে সরকারের মনোভাব স্পষ্ট, প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সে লক্ষ্যে বিকল্প উৎসের সন্ধান করছে সরকার।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ৩০০ কোটি ডলার ব্যয়ে মালয়েশিয়া সরকারের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের একটি প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। এ ছাড়া চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এদিকে বিকল্প উৎসের সন্ধানে বিদেশিদের পাশাপাশি দেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে সরকার। এরই মধ্যে স্থানীয় অনেক উদ্যোক্তা অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে বেসরকারি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এনা প্রপার্টিজ, বসুন্ধরা, ওরিয়ন গ্রুপ এবং জয়নুল হক সিকদারের মালিকানাধীন একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা বিদেশি উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করে স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে বলে সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রে জানা গেছে। নবনিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সেতু ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ
শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ হবেই এবং তা করা হবে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর কথামতোই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে_ এ মন্তব্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, বেসরকারি খাতের পরিচালনায় পিপিপির ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করা হবে। দুর্নীতি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। কারণ এ অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের জন্য দুর্নাম। এ সময় সেতু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব খোন্দকার আনোয়ার ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল সচিবালয়ে ডবি্লউএফপির ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎ শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের জবাবের অপেক্ষায় রয়েছি।
তবে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বেসরকারি খাত থেকে এ মুহূর্তে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন বাস্তবসম্মত হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, এটা করা হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, একই সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে দাতাদের সঙ্গে।
সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, নতুন যোগাযোগমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত জামালউদ্দিন সাবেহ সচিবালয়ে তার দফতরে দেখা করেন। বৈঠকে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলার অর্থায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাবটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবটি পর্যালোচনার জন্য সেতু বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে মালয়েশীয় সরকারের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সেতুর নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি কানাডীয় কোম্পানি নীতি বহির্ভূত কাজ করেছে বলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তে অভিযোগ এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ চাওয়া হয়েছে বলে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন সাকো ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এর পরপরই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের এ পর্যন্ত বৃহত্তম এ নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক লিড এজেন্সি হিসেবে কাজ করছে। ২৯০ কোটি ডলার বা ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ সেতু নির্মাণে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ। যৌথ অর্থায়নের কারণে অন্য দাতা সংস্থা এডিবি, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও তাদের অর্থায়ন বন্ধ রেখেছে। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে সরকারি সফর শেষে ফিরে এসে শনিবার জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় না করলে পিপিপির মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু মুখে বললে হবে না, দুর্নীতির ঘটনা প্রমাণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর পদ্মা সেতুর বিকল্প অর্থায়নের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় উঠে আসে। সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিতের ব্যাপারে আলোচনা হয়। বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী দাতা সংস্থার ঋণের বাইরে বিকল্প উৎস থেকে এ সেতু বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীরও সম্মতি পাওয়া যায় ওই বৈঠকে। এরপর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থায়নের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। একই সঙ্গে দেশি কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া থেকে একটি প্রস্তাব এসেছে। আরও কয়েকটি দেশের প্রস্তাব অপেক্ষায় রয়েছে।
জানা গেছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরানোর ফলে খুশি হতে পারেনি বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য হচ্ছে, শুধু মন্ত্রীকে সরালেই হবে না, পাশাপাশি কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকোর জড়িত থাকার অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তদন্ত না হলে টাকা ছাড় করা হবে না। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে অনড় অবস্থানে থাকায় সরকার কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ওপর। এরপরই প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে বিকল্প উৎসের ঘোষণা দেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা এখনও শেষ হয়নি। ১৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে বোর্ডসভায় বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা হবে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঢাকার কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ডস্টেইন ওয়াশিংটনে পেঁৗছেছেন। ওই বৈঠক থেকে অর্থায়নের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, টাকা ছাড় করবে না_ এমন কোনো বার্তা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। আমরা এখনও আশাবাদী, বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থায়নের স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে।
যোগাযোগ করা হলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ড. জায়েদ বখত সমকালকে বলেন, বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলে খরচ অনেক বেশি হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা এখানে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিনিয়োগ করবে। এটা করা হলে টোলের হার বাড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জনগণের ওপর। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক থেকে টাকা নিলে সুদ হার কম হবে। কারণ এ ঋণের সুদ হার খুবই কম এবং শর্ত সহজ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প হচ্ছে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প। কাজেই সরকারের এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যাতে জনগণ এ থেকে বেশি উপকৃত হতে পারে।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব বাস্তবসম্মত। সারাবিশ্বে অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা বড় বড় সেতু নির্মাণ করছেন। চীন, জাপান, দুবাই, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক বড় সেতু বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে। এক সময় এ ধরনের বড় প্রকল্পে সরকারের অর্থায়ন লাগত; কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা অর্থ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিওটির মাধ্যমে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তিনি মনে করেন, বেসরকারি মালিকানায় এটা করা হলে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে। এরপর সেতুর মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে চলে আসবে। তখন রাষ্ট্র তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী তা পরিচালনা করতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.