সময়ের প্রতিধ্বনি-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন by মোস্তফা কামাল

দেশের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে। শুধু সচেতন মানুষ নন, অতি সাধারণ মানুষও রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। সবাই বলেন, দেশের রাজনীতি ঠিক না হলে দেশ আগাবে না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনীতি যেমন মুখ থুবড়ে পড়ে, তেমনি তা মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ওপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সংগত কারণেই একজন মুটে-মজুর, একজন রিকশাওয়ালাও উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,
'ভাই, দেশের রাজনীতি কি আর ঠিক হইব না? এভাবে আর কত দিন চলব? একসময় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আনার জন্য কত আন্দোলন হইল, সেই ব্যবস্থা আবার বাতিলও হইল। কেন বাতিল হইল? কেন আবার সেই ব্যবস্থার জন্য রাজনীতির মাঠ গরম হইতেছে? এই দ্যাশের রাজনীতির খেলা কিছুই বুঝিতে পারি না।'
এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরও দেখি আমাদের নেতা-নেত্রীরা বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির খেলাই খেলছেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতির কথা ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন, কী ধরনের খেলা খেললে ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে সেই ভাবনা। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় বসে বিরোধীপক্ষকে বুটের তলায় পিষতে তাঁরা পছন্দ করেন। তারপর আবার বড় গলায় বলেন, 'একজনকে বুটের তলায় পিষলেই সব অর্জন ম্লান হয় না!' কী হাস্যকর উক্তি! কোনো নেতার মুখ দিয়ে এ ধরনের উক্তি বের হতে পারে, তা চিন্তাই করা যায় না।
যাহোক, আমরা মূল আলোচনায় ফিরে আসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি এবং তাদের শরিক জামায়াতসহ আরো কয়েকটি দল আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকায় সমাবেশ করে বলে দিয়েছেন, এবার নাকি তিনি ফাইনাল খেলবেন। আসলে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে তিনি সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবেন। সমাবেশ থেকে লংমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।
এদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নেবেন। তিনি বললেন, প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা যেতে পারে এবং এই ইস্যুতে আলোচনাও হতে পারে।
হ্যাঁ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং দুই কমিশনার নিয়োগ ছাড়াও নির্বাচন কমিশনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন করার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য ক্ষমতাসীন দলকেই বৈঠকের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু আলোচনার উদ্যোগটা আমরা এখনো দেখছি না।
১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নির্দলীয় সরকারের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি আলোচনায় আসেনি। ১৯৯৩ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপি সরকারের ব্যাপক কারচুপির কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি আলোচনার টেবিলে আসে। তারপর শুরু হয় আন্দোলন। তখন বিএনপিনেত্রী বেগম জিয়া বলেছিলেন, শিশু এবং পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তিনি কিছুতেই মানবেন না।
আন্দোলন-সংগ্রামের একটা পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। রাজপথে অনেক রক্তপাত হয়। কিন্তু তার পরও বেগম জিয়া অনড় ছিলেন। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন আমাদের দেখতে হয়েছে। ওই নির্বাচনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। দেশের অধিকাংশ জনগণ বিএনপির বিপক্ষে চলে যায়। পরে বাধ্য হয়ে বিএনপি সরকার জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান রেখে সংবিধানের সংশোধনী আনে।
১৯৯৬ সালের জুনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এরপর ২০০১ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। এর একটিতে বিএনপি এবং আরেকটিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট বিজয়ী হয়। যে যা-ই বলুক, এই তিনটি নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে রাজনৈতিক দলগুলো শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ত্রুটিগুলো নিশ্চয়ই আমাদের জানা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মেয়াদ সুনির্দিষ্ট ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে অধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। আর এর সুযোগ নিয়েছিলেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং রাষ্ট্রপতিরা।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ছিলেন তখন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই করেননি। পরে বেতার-টেলিভিশনের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেছিলেন।
তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি যিনি থাকবেন, তিনিও ইচ্ছা করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারবেন। এই সুযোগ নিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি সব বিকল্প যাচাই না করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন।
শুধু তা-ই নয়, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দলীয়ভাবে বিচারপতি নিয়োগ পাওয়া কে এম হাসানকে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা যায়, তাহলে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে পারবে। বিএনপির এই কৌশলটি বিরোধীদের কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তারা তখন কে এম হাসানের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু করে। সংবিধানে আছে, সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি কোনো কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে রাজি না হলে, তাঁর আগে যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাঁকে অথবা অ্যাপিলেট ডিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা যেতে পারে। তাঁদের কাউকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া না গেলে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নিতে পারবেন। অথচ এসব যাচাই না করেই রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন।
মেয়াদ নির্দিষ্ট না থাকার কারণে বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা নানা ফন্দিফিকিরও করেছিল। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছিল।
তা ছাড়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন উচ্চ আদালত। তবে রায়ে বলা হয়েছিল, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আরো দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা যাবে না।
ফলে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা এবং সমঝোতা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটির সমাধান সম্ভব নয়। এই ইস্যুতে বিএনপিকে বারবার আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু বিএনপি সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব দিতে পারেনি। আলোচনায়ও বসেনি। তখন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসলে এত জটিলতার সৃষ্টি হতো না। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে এ ক্ষেত্রে বিএনপি তার দায় এড়াতে পারে না।
এর আগেও এ বিষয়ে আমি লিখেছিলাম। তখন বলেছিলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা প্রয়োজন। তবে বিএনপিকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। কিন্তু বিএনপি সে পথে যায়নি। তারা ধরে নিয়েছে, এটা নিয়ে আলোচনা নয়, আন্দোলন করলেই ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করার প্রস্তাব নিয়ে এগোনোই ভালো বলে মনে করছি।
তা ছাড়া সরকার উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করতে পারে না। তাকে আদালতের রায় মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করতে হয়েছে। এখনো যে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এখনো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে এখন আলোচনা হওয়া উচিত নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার বিষয় নিয়ে। আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করা হলে এবং কমিশন পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত হলে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন নেই।
বিশ্বের কোনো দেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। সেসব দেশে কি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হচ্ছে না? তাহলে আমাদের দেশে কেন সম্ভব নয়? অন্যান্য দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন সরকার পুতুল সরকারের ভূমিকায় থাকে। রুটিন কাজ ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। ওই সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সব কিছু চলে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে।
দেশ বিভাগের পর থেকে নিকট প্রতিবেশী ভারতে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেখানে সব নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে হচ্ছে। কই সেখানে তো ভোট কারচুপির কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না! ভারতের নির্বাচন কমিশন এবং এ-সংক্রান্ত আইন আমাদের দেশের চেয়েও দুর্বল। অথচ নির্বাচনের সময় পুরো প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হয়ে যান ঠুঁটো জগন্নাথ। তাঁরা নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব খাটানো তো দূরে থাক, এলাকায় যেতেই পারেন না।
আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখে কিংবা আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করতে হবে।
আমাদের একটা কমন রোগ হয়ে গেছে। সরকার কোনো বিষয়ে 'হ্যাঁ' বললে বিরোধী দল সেটা ভালো হলেও 'না' বলবে। আবার বিরোধী দল 'হ্যাঁ' বললে সরকারি দল অযৌক্তিক হলেও 'না' বলবে। এই 'না' বলার সংস্কৃতি থেকে বের হতেই হবে। খোলা মন এবং আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। আলোচনায় বসলে নিশ্চয়ই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.