বাংলাদেশ যে কী খেলছে আর কী বলছে... by নোমান মোহাম্মদ

পাকিস্তানের ইনিংসে সেঞ্চুরিয়ান তিনজন। বাংলাদেশেরও তাই। বাড়তি হিসেবে আরো দুজন নার্ভাস নাইনটিজে। সফরকারীদের চেয়ে স্বাগতিকরা কম কিসে! বরং খানিক এগিয়েই তো! সমস্যা হলো, তুলনাটা পাকিস্তানের ব্যাটিং ইনিংসের সঙ্গে বাংলাদেশের বোলিং ইনিংসের। ব্যাট হাতে ইউনিস খান (২০০*), মোহাম্মদ হাফিজ (১৪৩) ও আসাদ শফিক (১০৪) ভেসেছেন টেস্ট সেঞ্চুরির আনন্দকল্লোলে। আর বল হাতে সাকিব আল হাসান (০/১২১), শাহাদাত


হোসেন (১/১১৩) ও ইলিয়াস সানি (৩/১২৩) ইনিংসে শতাধিক রান দিয়ে ডুবেছেন বিষাদের চোরাবালিতে। একটুর জন্য এই ত্রয়ীর সঙ্গী হলেন না রুবেল হোসেন (০/৯৭) ও মাহমুদ উল্লাহ (১/৯৪)। বাংলাদেশের বোলিং যে কতটা নির্বিষ, তা কি আর ব্যাখ্যার দাবি রাখে!
অজুহাত হিসেবে চাইলে কেউ উইকেটের কথা বলতে পারেন। অমন ব্যাটিংস্বর্গে বোলাররা আর কতটা কী করবে! কিন্তু পাকিস্তানিরা যে করল ঠিকই। মোহাম্মদ হাফিজ, সাঈদ আজমল, আবদুর রেহমানদের বল সাপের ছোবলের মতো গিয়েছে এদিক-ওদিক। হয়তো সেটি খুব নিয়মিত না। পাশাপাশি ধীরগতির উইকেট থেকে কোনো সাহায্য না পেলেও উমর গুল, আইজাজ চিমারা পেস-সুইং-বাউন্সের মিশেলে ভালোই সমস্যায় ফেলেছেন স্বাগতিকদের। আর নিজেদের বিলিয়ে দিতে তামিম-শাহরিয়ার-আশরাফুলরা ছিলেন বরাবরের মতোই অকৃপণ। ফল? দ্বিতীয় ইনিংসেরও ৪ উইকেট হাওয়া, এখনো পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস থেকে পিছিয়ে ৩২৫ রানে। পরাজয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে এখন যতক্ষণ লাগে আর কি!
দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রতিনিধি হয়ে একজনের আসার রেওয়াজটা পুরনো। সাধারণত দলের সেরা পারফরমারই আসেন সেখানে। তো বাংলাদেশের কারো তেমন কোনো পারফরম্যান্সই যে নেই। খুঁজেপেতে তাই নিয়ে আসা হলো 'সেঞ্চুরিয়ান' ইলিয়াস সানিকে। যাঁর তিন শিকারের একটি আবার আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের সৌজন্যে। টেস্ট অভিষেকে ৭ উইকেট নিয়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া এই বাঁহাতি স্পিনারের ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিতি অলরাউন্ডার হিসেবে। জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান-বোলারদের মনস্তত্ত্ব তাই তাঁর ভালোই বোঝার কথা। কিন্তু নার্ভাসনেস থেকেই কিনা অদ্ভুত সব ব্যাখ্যা দিয়ে গেলেন ইলিয়াস। উইকেট থেকে বাংলাদেশি স্পিনাররা টার্ন না পেলেও পাকিস্তানিরা পেয়েছে কী করে, এমন প্রশ্নে তাঁর জবাব, 'আসলে ওরা কতটুকু টার্ন পেল, দেখলামই। আমাদেরও যে টার্ন হয়নি, তা না। হয়েছে।' এমন উইকেটে দুই দলের ব্যাটসম্যানদের তফাৎ খুব একটা দেখছেন না বলেও তাঁর দাবি, 'তফাৎ কিছু না। আমাদের দলের ব্যাটসম্যানদের কোনো কারণে হচ্ছে না। আত্মবিশ্বাসে একটু ঘাটতি আছে বলে হয়তো হচ্ছে না। এ ছাড়া তো সব ঠিকই আছে। সাকিব ও নাজিম যেভাবে খেলছে, তাতে তো সব ঠিকই মনে হচ্ছে।'
আগের দিন সহ-অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং নিয়ে আশার গান শুনিয়েছিলেন। সে গানের সুর-তাল-লয় কেটে গেছে শুরুতেই। তামিম আরেকবার বোকা বনেছেন হাফিজে। ব্যর্থতার অর্গল ভাঙতে পারলেন না আশরাফুল। শাহরিয়ার নাফীস, নাসির হোসেন এমনকি অপরাজিত সাকিবের ব্যাটে কী যে তাড়া! তাঁদের ব্যাটিংয়ের ধরন দেখে মনে হতে পারে, হয়তো এটি টেস্ট না, টোয়েন্টি টোয়েন্টি। ৪৪ বলে ৪১ রান করা সাকিবের ঢাল ইলিয়াস হলেন এভাবে, 'ওর ব্যাটিংয়ের ধরনই এমন। ও এভাবে খেলেই অভ্যস্ত।' কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বেশি শট খেলছেন বলে মানছেন না তিনি, 'আমার তা মনে হয় না। ব্যাটসম্যানরা মারার বল মারছে, ঠেকানোর বল ঠেকাচ্ছে। তার পরও দুর্ভাগ্য যে আউট হয়ে যাচ্ছে।' কিন্তু পাকিস্তান তাদের প্রায় পৌনে দুই শ ওভারের ইনিংসে তো কখনো এমন তাড়া দেখাল না। এ ক্ষেত্রে ইলিয়াসের ব্যাখ্যা, 'পাকিস্তান যে মারেনি, তা না। তবে ওরা মনে হয় একটু সেফ ক্রিকেট খেলেছে।'
এই হচ্ছে মোদ্দাকথা। সেফ ক্রিকেট। হারতে হারতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া, আত্মবিশ্বাস চুরমার হওয়া বাংলাদেশেরই এই নিরাপদ ক্রিকেট খেলার কথা না? তা না করে রোমাঞ্চের সুলুকসন্ধানে ব্যতিব্যস্ত ব্যাটসম্যানরা। সহজাত ক্রিকেটের খোলসে হেঁয়ালি ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকছে যা। বুঝে কিংবা না বুঝে সে সবও স্বীকার করছেন না ইলিয়াস, 'আসলে আমরাও তো চেষ্টা করছি। আমাদের ব্যাটসম্যানরা এই সিরিজটা ভালো খেলতে পারছে না বলে আত্মবিশ্বাস কিছু কম আছে। তবে ব্যাটসম্যানরা চেষ্টা করছে। নাজিম আর সাকিবের ব্যাটিং দেখে এখন ভালোই মনে হচ্ছে।' এই ভালো আজ কতক্ষণ থাকে, সেটিই দেখার। তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এর প্রতিফলন টেস্টের বাকি অংশে থাকবে বলে এ বাঁহাতির আশা, 'পাকিস্তানিদের মতো আমরাও যদি সেফ ক্রিকেট খেলতে পারি, নাজিম-সাকিব যেমন খেলছে পরের ব্যাটসম্যানরাও তেমন খেলতে পারলে আমাদের ভালো খেলার সুযোগ আছে।'
আবারও সেই আশায় বসতি। জয়ের না, ড্ররও না_কেবল ভালো খেলার। প্রথম দিন ১৩৫ রানে অল আউট হয়ে ম্যাচের গন্তব্য এঁকে দেওয়া বাংলাদেশ এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা চাইতে পারে!
স্কোর কার্ড

No comments

Powered by Blogger.