পদ্মা সেতুর অর্থায়ন-বেসরকারি সূত্রে ঋণের শর্ত কঠিন হবে by খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

রকারি-বেসরকারি অংশদারিত্ব বা পিপিপির ভিত্তিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য বিভিন্ন দেশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আহ্বান জানানো হবে। কোনো দেশ আগ্রহ দেখালে তাদের সঙ্গে চুক্তি হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এলে তাদের সঙ্গে চুক্তি হবে এবং চুক্তি অনুযায়ী বিনিয়োগকারী অর্থ তুলে নেবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বলেই আমরা ধরে নেব। এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপট আমাদের জানা


আছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন একরূপ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের একাই দেওয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অর্থ ছাড় আকস্মিকভাবেই স্থগিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় সরকার অভ্যন্তরীণ ও বাইরের নানা চাপের মধ্যে পড়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ বক্তব্যকে আমরা তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারি। তবে এখনও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয় না। সরকার কিংবা বিশ্বব্যাংক কোনো পক্ষই এটা চাইবে না। এমনটি কোনো পক্ষের জন্যই ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না। পদ্মা সেতুতে ঋণ জোগাতে বিশ্বব্যাংকের আপত্তির পর সরকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। প্রথমে সচিবের পরিবর্তন ঘটেছে। তারপরে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে অন্য মন্ত্রণালয় দিয়ে মন্ত্রণালয়কে যোগাযোগ ও রেল_ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং দু'জন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ পেয়েছেন দায়িত্ব। এমন অবস্থায় পদ্মা সেতুর ঋণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার দুয়ার খুলে যাওয়ারই কথা। সরকারও নিশ্চয়ই সে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যে আমরা তেমন আভাস পেয়েছি। অর্থমন্ত্রীও একই সুরে কথা বলেছেন।
দ্বিতীয়ত, আমরা অর্থনৈতিক দিকটিও বিবেচনায় আনতে পারি। আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদে ঘাটতি রয়েছে এবং এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে হাত বাড়াতেই হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংেকর মতো প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিবেচিত হয় সহজ উৎস হিসেবে। তাদের ঋণের সুদের হার নামমাত্র এবং পরিশোধের মেয়াদ দীর্ঘ। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক যে ১২০ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি করেছে তার সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ এবং পরিশোধের মেয়াদ ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছর। এ ধরনের সহজশর্তের ঋণের ৭৫ শতাংশ শেষ পর্যন্ত অনুদানে পরিণত হয়ে যায়।
এখন আমরা বেসরকারি সূত্র থেকে ঋণ পাওয়ার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় নিতে পারি। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিংয়ে সম্প্রতি উন্নতি ঘটেছে। আমাদের দেশ ঋণের আসল ও কিস্তি পরিশোধে কখনও খেলাপি হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও সন্তোষজনক। কিন্তু তারপরও নানা কারণে বাংলাদেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় বিকল্প সূত্র সহজশর্তে ঋণ জোগাবে বলে মনে হয় না। তাদের ঋণের সুদের হার বেশি হবে। বিশ্বব্যাংক কেন ঋণ স্থগিত রেখেছে, সে বিষয়টিও তারা বিবেচনায় নেবে এবং এ কারণেও শর্ত কিছু কঠিন হতে পারে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক কেবল একটি প্রকল্পে ঋণের সংস্থান করে না। বাংলাদেশে তাদের আরও আর্থ-সামাজিক প্রকল্প রয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তাদের ঋণ ছাড় করা স্থগিত থাকলে অন্যান্য প্রকল্পেও তার প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর ঋণ ছাড় করার বিষয়ে দ্রুত একটি মীমাংসায় উপনীত হওয়া প্রয়োজন মনে করি।
বেসরকারি সূত্র থেকে ঋণ নেওয়া হলে তার শর্ত সহজ হওয়ার কথা নয়। বিওটি বা বিল্ট, ওন ও ট্রান্সফার পদ্ধতিতে পদ্মা সেতুর কাজ হলে টোলের হার কী হবে সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ হার বেশি পড়লে তার প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। সেতু ব্যবহারকারীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হলে শিল্প ও কৃষির মতো উৎপাদনমূলক খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। মানুষের যাতায়াত ব্যয়ও বাড়বে। এ ধরনের সামাজিক ব্যয় সম্পর্কে সরকারকে সবসময়ই সতর্ক থাকতে হয়। বেসরকারি খাতের সঙ্গে সেতু নির্মাণের চুক্তি করার সময় এই সামাজিক ব্যয়ের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা দ্রুত রিটার্ন চাইবে এবং এ কারণে টোলের হার বেশি ধরার জন্য চাপ আসা স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা তাই এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক এবং তাকে আমরা চাপের মুখে ভারসাম্য আনার চেষ্টা হিসেবে দেখতে পারি। অর্থনৈতিক বিবেচনায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সহজ করার জন্য অপরিহার্য এ সেতুর নির্মাণ কাজে অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ফয়সালাই উত্তম।

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম :সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো

No comments

Powered by Blogger.