রাষ্ট্র ও সমাজ কেন এগোয়নি by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাঙালিকে বলা হয় অতিরিক্ত রাজনীতিসচেতন। এটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা রাষ্ট্র ও রাজনীতি বাঙালির জীবনকে দীর্ঘকাল ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। পরাধীনতার একটি বিরাট যুগ আমরা তো পার হয়ে এসেছি। কিন্তু সাতচলি্লশের স্বাধীনতা, এমনকি একাত্তরের স্বাধীনতাও বাঙালিকে মুক্ত করেনি। সে জন্য রাজনীতির গুরুত্বটা রয়েই গেছে। মানুষ সমাজেই বাস করে। সে জন্য সমাজ রাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সমাজের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র চলে।


সেই সঙ্গে এটাও মানতে হয়, রাষ্ট্র যেভাবে সমাজের ওপর কর্তৃত্ব করে, যেভাবে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে_সমাজ সেটা করতে পারে না। তবে আমরা বলতে পারি, সমাজের কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছায় রাষ্ট্র চলে।
আমরা যে রাষ্ট্র পেয়েছি, সেটাকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বলা হয়। কিন্তু এটা জনগণকে স্বাধীনতা দেয়নি, নিরাপত্তা দেয়নি, মুক্তি দেয়নি। রাষ্ট্র কেন জনগণকে প্রত্যাশিত মুক্তি দিতে পারল না, তার কারণ হচ্ছে_রাষ্ট্র চলে গেছে শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে। খুবই স্বাভাবিক যে শাসকরাই রাষ্ট্র চালাবে। কিন্তু আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী জনগণের নয়, নিজেদের স্বার্থ দেখে। এ শাসকশ্রেণী কখনো বৈধ, কখনো অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এ ব্যাপারে তারা যদি মীমাংসায় আসতে পারত, তাহলে তাদের মধ্যে কলহ থাকত না। কিন্তু যেহেতু তারা ক্ষমতা ভাগাভাগির মীমাংসায় আসতে পারে না, সে জন্যই কখনো সামরিক শাসন আসে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে, তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন চলে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার যে চরিত্র দেখি, সেটা আসলে লুণ্ঠনেরই প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই বাধা দিয়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, এ দেশ প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, এখানে সমাজ বিপ্লব ঘটে যাবে। তখন এ রাষ্ট্র আর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। পাকিস্তানকে তারা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, কিন্তু বাংলাদেশকে রাখতে পারবে না। এ আশঙ্কা থেকেই তারা একাত্তরে বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। এমনকি যুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে পড়ল, সেটা যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়, সে জন্য চেষ্টা করেছে। তাদের আশঙ্কা ছিল, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এর নেতৃত্ব তথাকথিত চরমপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। এমনকি ভারতও এ ব্যাপারে চিন্তিত ছিল। যে কারণে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তার পাশাপাশি ভারত মুজিব বাহিনীও গঠন করেছিল। এ বাহিনী গঠন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ভারত ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো চেয়েছিল পুরনো রাষ্ট্র ভেঙে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতেই পারে; কিন্তু সমাজে যেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হয়। নতুন রাষ্ট্র যেন গণতান্ত্রিকও না হয়।
গণতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি? নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার নয়। নির্বাচিত সরকার অনেক সময় অনির্বাচিতদের তুলনায় বেশি নিপীড়নকারী হতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকার ও সমাজ বলতে আমরা সে রকম ব্যবস্থা বোঝাব, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ বৈষম্য ঘুচে যাবে। তখন আর সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পক্ষে বিভাজন থাকবে না। সর্বোপরি শ্রেণীবৈষম্য থাকবে না। এটা হচ্ছে প্রথম শর্ত। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, ক্ষমতা কোনো এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত থাকবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে। তৃতীয় হচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র আমরা চেয়েছিলাম, সেটা আমরা পাইনি। যে কারণে আমরা মুক্ত হতে পারিনি।
রাজনীতি এখনো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাষ্ট্র জনগণের মিত্র নয়। পরাধীনতার যুগে রাষ্ট্র যেখানে জনগণের শত্রু হিসেবে কাজ করেছে, এখনো সে ভূমিকার পরিবর্তন ঘটেছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে না। তারা দেখতে পায় একটি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের ওপর চেপে বসে আছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তাও দিতে পারছে না। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নেই। ব্যক্তিগত জীবনেও নিরাপত্তা আছে, তেমনটি নয়। বিশেষ করে মেয়েরা খুবই অনিরাপদ অবস্থায় রয়েছে। সমাজে নারী নির্যাতনের মাত্রা এখনো উদ্বেগজনক।
মাঝে জনগণকে রাজনীতিবিমুখ করার চেষ্টা হলো। এমনটি আগেও ঘটেছে। রাষ্ট্রের কর্তারা চেয়েছেন জনগণ যেন রাষ্ট্র সম্পর্কে উদাসীন থাকে। জনগণকে রাজনীতির ব্যাপারে নিরুৎসাহী করার চেষ্টা সব সময়ই ছিল। সাম্রাজ্যবাদীরা নানাভাবে রাজনীতিবিমুখ করতে চায়। ধরা যাক তাদের আনুকূল্যে পরিপুষ্ট এনজিও তৎপরতার কথা। এনজিওগুলো বলে, প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, নিজের উন্নতি করতে চাইবে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প সামাজিক মানুষকে পুঁজিবাদী মানুষে পরিণত করতে চায়। রাষ্ট্র নিজেই পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান। সেটা চায় তার নাগরিকরা আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী হোক। তাতে মানুষ শাসকদের জনবিরোধী কাজ সম্পর্কে উদাসীন থাকবে। ফলে শাসকশ্রেণীর সুবিধা হবে। রাষ্ট্র চায় এমন কিছু ইস্যু তৈরি করতে, মানুষ যেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে অস্পষ্টতায় ভুগবে। শিক্ষার বিভিন্নমুখী ধারার মাধ্যমেও কিন্তু সমাজকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের মতো এ শিক্ষার উন্নতিও ব্যক্তির উন্নতি। এ ব্যক্তি সমাজ, রাষ্ট্রের কথা না ভেবে কেবল নিজের কথা ভাববে_সেটাকে উৎসাহী করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কী করণীয়। একাত্তরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছেছিলাম। সেখান থেকে রাষ্ট্র ও সমাজকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজকে রূপান্তরিত করে তোলা উচিত ছিল। তাদের গণতান্ত্রিক করে তোলা উচিত ছিল। সেটা তো করা হয়ইনি; বরং একাত্তরের আগের বিত্তবানরা আরো বেশি বিত্তবান হয়েছেন। তাঁদের সহযোগীরা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বড়লোক হয়েছেন। শ্রেণীবিভাজন বেড়েছে। আত্মকেন্দ্রিক শাসকশ্রেণীর আদর্শই জনগণের আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ আদর্শ হচ্ছে ভোগবাদী, পুঁজিবাদী আদর্শ। এমন আদর্শের কারণেই আমরা রাষ্ট্র ও সমাজকে রূপান্তরিত করতে পারলাম না। প্রয়োজন ছিল প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তি বিজয়ের মুহূর্তকে নিজেদের হাতে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। যাদের এটা করার কথা ছিল, তারা বিভ্রান্ত ছিল, ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। তাদের কেউ শাসকশ্রেণীর লেজুড় হয়েছে, কেউ অতিবিপ্লবী হয়ে পড়েছে। দুটি প্রবণতাই শাসকশ্রেণীকে সুরক্ষিত করেছে। করণীয়টা হচ্ছে রাজনৈতিক। শাসকশ্রেণীর নিজেদের স্বার্থে রাজনীতির বিপক্ষে জনগণের পক্ষের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা জরুরি। একাত্তরের বিজয়ের পেছনে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রূপান্তরের রাজনীতি ছিল। সেটাকেই এগিয়ে নেওয়া দরকার। তাই বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ মোটেই শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের এখনকার দায়িত্ব। এ কাজটা করতে হবে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে।
নতুন সমাজ ও নতুন ধরনের রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমরা নতুন সংস্কৃতিও চাইব, যে সংস্কৃতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোকাঠামো বদলে দেবে, মানুষকে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক করে তুলবে। ওই সাংস্কৃতিক লক্ষ্য অর্জন করাই হবে আমাদের রাজনৈতিক তৎপরতার মূল কেন্দ্র। অর্থাৎ কেবল রাজনীতি দিয়ে হবে না, কেবল সমাজ সংস্কারের কাজ দিয়েও আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না। আমাদের রাজনৈতিক কাজের সম্পূরক হিসেবে সাংস্কৃতিক কাজকেও এগিয়ে নিতে হবে। যে কারণে আমরা চাইব একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠুক। নাটক, গান, নৃত্য, গ্রন্থাগার, প্রদর্শনীর বিপুল আয়োজন দরকার। তবে সেটা যেন কোনো অবস্থায়ই আদর্শনিরপেক্ষ না হয়। অতীতে রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা কিছু তৎপরতা দেখেছি। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে খুবই উপেক্ষিত থেকেছে। এর ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তন, সংরক্ষণ ও প্রভাবিত করার কাজটি হয়নি। সাংস্কৃতিক কাজ বলতে আমরা কেবল বিনোদনই বুঝিয়েছি। আমরাই নিজেদের কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছি। যতই কৃষি ও কৃষকের উন্নতির কথা বলা হোক। কিন্তু কৃষিকেও অবহেলা করা হয়েছে। এ খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বদলে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমরা এখন উৎপাদনকারীর বদলে ক্রেতা ও সেবকে পরিণত হয়েছি। আমাদের প্রধান সম্পদ পানিকেও অবহেলা করেছি। নদী শুকিয়ে যেতে দিয়েছি।
আমরা সমুদ্রকেও উপেক্ষা করেছি। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। বাংলাদেশ কেবল নদীমাতৃক নয়, সমুদ্রমাতৃকও বটে। বঙ্গোপসাগর বাংলার সম্পদ। কিন্তু এর সম্পদ আহরণ করাই হয়নি; উপরন্তু সমুদ্রসীমাও আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। ভারত ও মিয়ানমার আমাদের অংশকে তাদের সীমানা বলে দাবি করছে এবং নানা ধরনের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। আমাদের শাসকশ্রেণী এ বিষয়ে চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করছে। এর জন্য তাদের একদিন হয়তো ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। একটি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী পানিসম্পদের সদ্ব্যবহারের দিকে নজর দেবে, আমাদের নৌপথ সজীব রাখবে, পানিদূষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে_সেই স্বপ্নে আমাদের সমুদ্রসম্পদ আহরণের ব্যবস্থা করবে। আমাদের যে রাজনীতি প্রয়োজন, সেটা প্রচলিত রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। মিছিল, বিবৃতিদান বা সংঘর্ষের রাজনীতি নয়। এটা একাধারে সমাজকে পরিবর্তিত ও এ জনপদকে সমৃদ্ধ করার রাজনীতি। কেবল উৎপাদনে স্বাবলম্বী হওয়া নয়, সুষম বণ্টনও চাই। আর একই সঙ্গে আমাদের দায়িত্ব হবে সমাজে চাঞ্চল্য ও আশাবাদ ফিরিয়ে আনা। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে আমাদের সে কাজটিই করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.