চরাচর-চার শ বছরের আখড়া

বৃহত্তর সিলেট বিভাগের মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো যে কয়টি স্থান রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো, হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গল গ্রামের আখড়াটি। যেটাকে মানুষ বিথঙ্গলের আখড়া বলে অভিহিত করে থাকে। এই আখড়াটি বয়সের দিক থেকে অনেক পুরনো। হিসাব করে বলা হয়ে থাকে, আখড়াটির বয়স হবে প্রায় ৪০০ বছরের মতো বা তার একটু বেশি অথবা এর কাছাকাছি। বিথঙ্গলের আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন হবিগঞ্জ জেলার মাছুলিয়া


গ্রামের আরেকটি স্বনামধন্য আখড়া মাছুলিয়া আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা জগন্মোহন গোঁসাইর পুত্র ও শিষ্য শান্ত গোঁসাইয়ের শিষ্য রামকৃষ্ণ গোঁসাই। ১৫৭৬ সালে হবিগঞ্জ জেলার রিচি গ্রামের বনমালী দাস ও মা জাহ্নবী দাসীর ঘরে রামকৃষ্ণ গোঁসাই জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে বাবা বনমালী দাসের মৃত্যু হলে তিনি সমাজ-সংসারের প্রতি উদাসীন হয়ে ওঠেন। শেষে বৈরাগ্য সাধনে মনস্থির করে শান্ত গোঁসাইয়ের কাছে দীক্ষা নিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণ গোঁসাই 'জয়ব্রহ্ম' মন্ত্র বুকে ধারণ করে বাড়ি থেকে বের হন এবং বর্তমান বিথঙ্গলে এসে একটি তৃণকুটির স্থাপন করে এখানেই থেকে যান। ইতিহাস নিয়ে যাঁরা নাড়াচাড়া করেন, তাঁদের মতে, গভীর অরণ্যের মাঝে বিভিন্ন ধরনের হিংস্র পশু, পোকামাকড় ও বিষাক্ত সাপের ভয় উপেক্ষা করে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ভিড় জমাতে থাকে। এই গভীর অরণ্যই মানুষের পদচারণায় একসময় দিনে দিনে লোকালয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে ও বৃহৎ আখড়ায় পরিণত হয় তৃণকুটিরটি। ৩৬০টি আখড়ার প্রতিষ্ঠা দলের প্রতীক রামকৃষ্ণ গোঁসাই ১০৫৯ সালে মাঘীপূর্ণিমায় দেহত্যাগ করেন। এক সংবাদ ভাষ্যে বলা হয়, রামকৃষ্ণ ধর্মের (কথাটা সম্ভবত হবে বৈষ্ণব ধর্মের) ৪০০ আখড়ার মধ্যে বিথঙ্গল আখড়াটি সর্বপ্রথম। এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে বর্তমান আখড়ার স্থানটি বানিয়াচংয়ের কোনো এক মুসলিম জমিদার দান করে গেছেন। আখড়াটি প্রথমে ছন-বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। পরে তা বিভিন্ন জনের পৃষ্ঠপোষকতায় দালানকোঠায় রূপ নেয়। জানা যায়, আগরতলার মহারাজ স্বর্গীয় কৃষ্ণকিশোর মানিক্য বাহাদুর সর্বপ্রথম অট্টালিকা নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে নরেন্দ্র গোঁসাই আরো অনেক দালান নির্মাণ করেন। এই আখড়াটিতে ১২০টি কক্ষ রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় রামকৃষ্ণ গোঁসাই প্রতিষ্ঠিত বিথঙ্গলের আখড়ার ঘরদুয়ারের দৈন্যদশা সবার চোখে পড়ার মতো। বেশির ভাগ কক্ষই ভাঙাচোরা। দেখা যায় যে ১৫ ফুট উচ্চতায় আট হাত বর্গাকারের কক্ষগুলোর কোনো দরজা-জানালা নেই। প্রাচীন নকশাগুলো পরিচর্যার অভাবে ম্রিয়মান অবস্থায় শোভা পাচ্ছে। আখড়ার দালানের ছাদ ফেটে যাওয়ায় তা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বর্তমানে দায়িত্বরত সুকুমার দাস মোহন্ত গোস্বামীর কক্ষটি টাইলস করা এবং তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া বিদ্যমান। সুকুমার দাস মোহন্ত গোস্বামীর কক্ষে আছে ভিসিডি ও সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা। এ ছাড়া সুকুমার দাস মোহন্ত গোস্বমীর কাছে বিথঙ্গল ও তার আশপাশের গ্রামের লোকজন আরোগ্য লাভের জন্য জলপড়া, মাটিপড়ার ইত্যাদির জন্য আসে। হয়তো তারা কিছু পায়। যারা আসে তারাই তার গুণ বলতে পারবে। বিথঙ্গলের আখড়াটি অনেক সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আখড়ার জায়গা দখল করে নিয়েছে। বর্তমান অবস্থায় আখড়াটি সংস্কার করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রশাসনসহ সবার দায়িত্ব হচ্ছে, যেসব সম্পত্তি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে সেসব সম্পত্তি উদ্ধার করা। বর্তমান কমিটি হয়তো আখড়ার বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও সংস্কার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। অনেকেই মনে করেন, আখড়াটি সংস্কারের জন্য ১৫ লাখ টাকার তহবিল গঠন করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ জন্য আরো অর্থের প্রয়োজন হবে। সবাই চান, যেহেতু বিথঙ্গলের আখড়াটি স্থাপত্য শিল্পের একটি নিদর্শন, তাই আখড়াটির জন্য সরকারের কিছু করা উচিত। বর্তমানে বিথঙ্গলের আখড়াটি ভক্তদের দান-অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলছে। এই আখড়ার জীর্ণ অবস্থা দূর করার জন্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাত থেকে আখড়ার সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন_এটাই আশা করে ভক্তদের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীও।
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল


No comments

Powered by Blogger.