সম্পাদকীয়- বাংলা একাডেমী এবং আমাদের বইমেলা

রাজধানীতে প্রতিবছরই অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকৃত সত্য এই যে, সারা বছরই বইমেলা থাকার কথা, বই একদিন বা এক মাসের জন্য নয়, বই হওয়া উচিত নিত্য সঙ্গী।
বইমেলা হবে বসতঘরের সঙ্গি। বই একাকীত্বকে দূর করে। মনকে প্রফুল্ল রাখে। মেধা বিকাশে প্রধান সহায়ক হচ্ছে বই। শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতী, নর-নারী সবাই বই বিহীন অচল। জ্ঞানের আলো হচ্ছে বই, আলোকিত মানুষের নাম বই। ডাক্তার, কবিরাজ, বৈজ্ঞানিক, পাইলট, শিক্ষক, আইনজীবী সব পেশাশ্রেণী বইয়ের মাধ্যমে নিজ নিজ অবস্থানে পৌঁছতে সমর্থ হয়েছেন। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে, ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ করছে, আকাশে বিমান উড়ছে, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল, ডিস সবকিছু আবিষ্কারের মূলে যার অবদান তার নাম হচ্ছে বই। সুবিধা অর্জন ও মেধা বিতরণের মূল শক্তি হচ্ছে বই। শক্তি প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে বইমেলা। মেধা অর্জনে বই ক্রয় করবে পাঠক এবং মেধা বিতরণে ভূমিকা রাখবে বইমেলা। বইমেলার ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে বইমেলার সার্থকতা। নামে বইমেলা হলেই চলবে না। বইমেলায় মেধা অর্জনের মতো মেধাসম্পন্ন লেখকের বইয়ের সমাহার থাকা চাই। শিশুদের মেধা বিকাশে সহায়ক এমন বই থাকতে হবে বইমেলায়। পর্যটকদের ক্ষুধা মিটাতে পর্যটন বিষয়ে ভ্রমণগাইড থাকতে হবে মেলায়। গেল বছর পর্যটন বিষয়ে নতুন ভ্রমণগাইড পাওয়া যায়নি। বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত ভ্রমণগাইডের ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও মেলায় সেটি পাওয়া যায়নি। চলতি বছরে তা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। সমাজ, প্রথা, সামাজিক ও পরিবারিক রীতিনীতি, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, কৃষি, নদ-নদী, চরবাসীর জীবনযাপন, বঙ্গবন্ধুর জীবনী এসব নিয়ে লেখা বই থাকতে হবে মেলায়, খেলাধুলা ও শিশুদের অজানা বিষয়ে জানতে বই প্রয়োজন, রাজনীতির ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিক্রমপুরের প্রাচীন ইতিহাস, মওলানা ভাসানীর জীবনকাহিনী নিয়ে লেখা বই সংগ্রহ করে মেলায় বিক্রি করতে হবে। কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, মুনতাসীর মামুন, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমদ প্রমুখের বইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
বইয়ের অপর নাম জ্ঞানভা-ার। বই অমানুষকে মানুষ করতে পারে। রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রকে গণতন্ত্রে পরিণত করতে পারে। বর্তমান সভ্য পৃথিবীতে অস্ত্র অর্থহীন, ক্ষমতা অস্থায়ী, বর্বরতা ক্ষণস্থায়ী। বই স্থায়ী, সভ্যতার মূল ধারা। বই না থাকলে পৃথিবীতে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকত না, শিক্ষক তৈরি হতো না। ছাত্রছাত্রী দেখা যেত না। তাই বইবিহীন বইমেলা অচল এবং ভাল বই মেলার কদর বৃদ্ধিতে সহায়ক। বাংলাদেশের বাঙালীর বাংলা একাডেমী বইমেলাকে সার্থক করতে ভূমিকা পালন করবে এটাই প্রত্যাশা। বইমেলা যদি হয় ব্যবসার জন্য তা হলে মেলা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। চাহিদা হ্রাস পাবে। ক্রেতাদের উৎসাহ ও আগ্রহ কমে যাবে। হ্রাসকৃত মূল্য তথা নামমাত্র মূল্যে বই বিক্রি করতে হবে মেলায়। মূলত শ্রোতা ও পাঠকের আগ্রহ বাড়াতে মেলা। বাংলাদেশকে বিশ্বে তুলে ধরতে বাংলা একাডেমীর ভূমিকা ব্যাপক, অথচ শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানটির কথা স্মরণ করে না, ভাবে না, জানে না। প্রতিষ্ঠানটির কাজ কি তাও জানার সুযোগ নেই। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানভা-ার ও মেধায় ভরপুর প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ঘরে ঘরে বাংলা একাডেমী তৈরি করতে হবে। বইমেলা রাজধানীভিত্তিক হলেই চলবে না। মেধা অর্জন ও মেধা বিতরণে প্রতিটি উপজেলায় বইমেলার আয়োজন করতে হবে। বইয়ের ওপর ভর্তুকি দেবে সরকার। প্রকাশকরা চালাকির আশ্রয় নিচ্ছে। একটি বই যেখানে পঞ্চাশ টাকা হওয়া উচিত সেখানে দু’শ’ টাকা মূল্য লিখে এক শ’ টাকা কমিশন বাদ দিচ্ছে। এভাবে পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্ত নিয়ে নিচ্ছে। কি কারণে, কি জন্য কমিশন তা জানা যায় না। বইয়ের মূল্য নির্ধারণ, কমিশন, বই প্রকাশনা এসব দেখভাল করতে অভিজ্ঞ, দক্ষ, নিরপেক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত একজন মহাপরিচালক দায়িত্ব পালন করলে দেশের মানুষ জানার মতো, জ্ঞান অর্জন করার মতো বই বাজারে ও বইমেলায় পেতে পারে। রূপকথার গল্প, কল্পকাহিনী, রাক্ষসের গল্প এসব শিশুদের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হবে না।
বৈজ্ঞানিক যুগে শিশুদের মিথ্যা-বানোয়াট কাহিনী দিয়ে সাজানো বই পড়তে দেয়া যাবে না। সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে শিশুদের জন্য জাতির পিতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস, আলবদর, আল-শামস্ এবং যুদ্ধাপরাধীদের ইতিহাস জানার মতো বই থাকতে হবে মেলায়। বাংলাদেশের শুদ্ধ মানচিত্র, সংবিধান ও রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, পর্যটন স্পট প্রভৃতি দলিল ও বই সংগ্রহে থাকতে হবে মেলায়। থরে থরে বই থাকলে হবে না স্টলে। জ্ঞান অর্জন করার মতো বই সংগ্রহে থাকতে হবে। বইমেলার নিরাপত্তার কথাও স্মরণে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে বিক্রমপুরের মেধাবী কৃতী সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করা হয়েছিল। পরে তিনি জার্মানিতে মারা যান। বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে দেশের জ্ঞানী, গুণী ও বুদ্ধিজীবীর আগমন ঘটে। নিরাপত্তা জোরদার করার প্রতি নজর রাখতে হবে। বৃদ্ধদের প্রতি নতুন প্রজন্মদের সম্মান দেখানো, আদর্শ, শিষ্টাচার, সমাজে অবদান এসব নিয়ে লেখা বই থাকতে হবে মেলায়।
মেলা নিরিবিলি, রাস্তায় ছিনতাইকারীদের পাকড়াও করে নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকা চাই। উচ্চবিত্ত, ডাক্তার, প্রফেসর তথা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বইমেলা সীমাবদ্ধ থাকলে এর সার্থকতা হারিয়ে যাবে। সাধারণ পেশার মানুষকে বইমেলা বিষয়ে জানাতে হবে এবং উৎসাহ দিতে ব্যাপক প্রচার করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। বইয়ের প্রতি আগ্রহ জ্ঞান অর্জনে একমাত্র সহায়ক। জ্ঞান আলো ছড়ায়। অন্ধ লোকও সে আলোতে আলোকিত হয়। বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে তৈরি হোক মিনি লাইব্রেরী। লাইব্রেরীর সঙ্গে সম্পর্ক বইয়ের। সুতরাং বইমেলা অসংখ্য বইয়ের আলোতে হোক আলোকিত।

মোঃ মেছের আলী
শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.