সুন্দরবন ॥ ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছেই

সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশেরই নয় সমগ্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন। প্রকৃতিগতভাবেই সুন্দরবন আমাদের সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয় থেকে সব সময় রৰা করে আসছে।
কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরেই এই বনকে উজাড় করার নেশায় মত্ত। তেমনি প্রাকৃতিক এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেও হারিয়ে যেতে শুরম্ন করেছে বনের অনেকাংশ। এই বন যেমন আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশ সুরৰার সবচেয়ে বড় বন্ধু, তেমনি বনের ওপর নির্ভর করে অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা। শুধু তাই নয়, এই বনের ওপর প্রত্যৰ ও পরোৰভাবে নির্ভর করে বেঁচে আছে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী।
কিন্তু একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী তাদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের লৰ্যে বন ধ্বংসে কোন দ্বিধাবোধ করে না। তারা ইচ্ছেমতো নির্বিচারে বেআইনিভাবে বনের গাছ কেটে বনের ও সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। তেমনি বনের পশুপাখি হত্যা করে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। যার ফলে ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে বনভূমি এবং হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও বিভিন্ন সময় সুন্দরবনের ব্যাপক ৰতিসাধন হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর সুপার সাইকোন ঘূর্ণিঝড় সিডরের আক্রমণে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চরম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সুন্দরবনের ৬ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর বনভূমির প্রায় ৪ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর ৰতির সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার হেক্টর বনভূমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মারা যায় বাঘ, হরিণসহ অসংখ্য পশুপাখি। এই ব্যাপক ৰতি এখনও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর পর পরই আবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার ৰয়ৰতির পরিমাণও সিডরের মতো বেশি না হলেও একেবারে কম নয়।
সাম্প্রতিককালে চকরিয়ার সুন্দরবনে মড়কের আক্রমণ শুরম্ন হয়েছে। এই মোড়কে অত্র এলাকায় অসংখ্য গাছ আক্রানত্ম হয়ে মরে যাচ্ছে। আক্রমণের পরে গাছগুলো লালচে রঙ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে পাতা ও ডালপালা শুকিয়ে গাছগুলো মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের গাছের মড়কের অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ধরনের উপকারী পোকামাকড় হারিয়ে যেতে বসেছে। যার ফলে বনাঞ্চলে পাখিদের সংখ্যাও উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। সেই কারণে গাছে ৰতিকর পোকার আক্রমণ বেড়েছে। এ ধরনের পোকার আক্রমণের ফলে গাছগুলো রোগাক্রানত্ম হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সমুদ্রের পানির আদর্্রতা ও লবণাক্ততা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। অসহনীয় পর্যায়ের লবণাক্ততাও গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অনত্মরায় হিসেবে কাজ করে। এছাড়া কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও জাহাজের ৰতিকর বর্জ্য বন ধ্বংসে প্রত্যৰ ও পরোৰভাবে কাজ করছে।
শত শত বছর আগে প্রাচীন সমতটের দৰিণাংশে লবণাক্ত বেলাভূমিতে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে যে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল গড়ে উঠেছিল তার প্রধান বৃৰ ছিল সুন্দরী। সুন্দরী বৃৰের এই বনভূমিই সুন্দরবন। ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৫ সালে এই বনকে সংরৰিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৭৯ সালে বনভূমি রৰণাবেৰণের জন্য বন বিভাগকে নিযুক্ত করা হয়। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ বন সংরৰক ডি প্রিইন একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখেন সুন্দরবনে মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৫০ প্রজাতির সত্মন্যপায়ী প্রাণী, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। কিন্তু দুনর্ীতি, অবহেলা, চৌর্যবৃত্তি এবং সংরৰণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার কারণে এটা এখন ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। ১৯২৮ সালে আরেক ব্রিটিশ বনসংরৰক এমজে কাটিজ সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে। এখনও সুন্দরবন ঐ কাঠামো অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে আমাদের অহঙ্কার সুন্দরবনকে জাতিসংঘের ইউনেস্ক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে।
সুন্দরবন আমাদের দেশের পরিবেশ প্রতিবেশের প্রধানতম নিয়ামক। দেশের সার্বিক পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখতে সুন্দরবনের সঠিক রৰণাবেৰণ অত্যনত্ম জরম্নরী। অন্যথায় এই বঙ্গভূমির পরিবেশ ভারসাম্য রৰা করা অত্যনত্ম দুরূহ হয়ে পড়বে।

শাম্মি আখতার

No comments

Powered by Blogger.