খাদ্যচক্রে আর্সেনিক by ইয়াসরেমিনা বেগম সীমা

আর্সেনিক দূষণ ও তার তিকর প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিগত দেড় দশক ধরে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে যেমন চলছে অবিরাম প্রচারণা তেমনি দেশে-বিদেশে চলছে বিভিন্ন গবেষণা।
আর্সেনিকের ঝুঁকি ও আর্সেনিকযুক্ত এলাকায় পানিকে নিরাপদ করতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আর্সেনিকের ভয়াবহতা রোধে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও ক্রমেই বাড়ছে আর্সেনিকের ঝুঁকি, বেড়ে যাচ্ছে আর্সেনিকোসিস রোগীর সংখ্যা। আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব যে এলাকায় হয়েছে সেখানকার নলকূপগুলোকে লাল আর সবুজ রং দিয়ে আর্সেনিকযুক্ত কিংবা আর্সেনিকমুক্ত চিহ্নিত করা ছাড়া আর কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। অবশ্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিজ্ঞানী পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফিল্টার আবিষ্কার করেছেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য বাংলাদেশের কৃতীসনত্মান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. আবুল হুসসাম আবিষ্কার করেছেন সনো ফিল্টার, যা পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করে পানোপযোগী করতে পারবে। কিন্তু গবেষকরা দেখিয়েছেন সনো ফিল্টার পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করতে পারে ঠিকই, কিন্তু ছয় মাস পর পর এর ভেতরের যন্ত্র বদল করতে হয়। তা না হলে এটি অকার্যকর হয়ে যায়। এটি একদিকে যেমন গ্রামের সাধারণ মানুষ জানে না অপরদিকে তেমনি ব্যয়বহুল। এছাড়া চট্টগ্রামের কেমিস্ট এবং শিল্পবর্জ্য ও পানি পরিশোধন পস্নান্টের কনসালট্যান্ট শ্যামল চৌধুরী গভীর ও অগভীর নলকূপের পানির আর্সেনিক ও বিষাক্ত খনিজ দ্রব্য শোষণে সম একটি ফিল্টার যৌগ উদ্ভাবন করেছেন। শ্যামল চৌধুরীর এই ফিল্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একই সঙ্গে কয়েকটি পরিবারের ব্যবহার উপযোগী। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চট্টগ্রামের সীতাকু- এলাকার আর্সেনিকদূষিত নলকূপের পানি এবং ফিল্টারযৌগটি দ্বারা পরিশোধিত পানির নমুনা বিশেস্নষণ করে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার পানির আর্সেনিক ও বিষাক্ত খনিজ উপাদান শোষণকারী উদ্ভাবিত যৌগটির প্যাটেন্ট প্রদান করেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নত দেশের পানীয় পানির আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম (৫০ মাইক্রোগ্রাম)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রহণযোগ্য মাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম বা ১০ মাইক্রোগ্রাম। চট্টগ্রামের সীতাকু- এলাকার ০.১৭৩৫ মিলিগ্রাম (১৭৩.৫ মাইক্রোগ্রাম) মাত্রায় আর্সেনিকদূষিত নলকূপের পানি উদ্ভাবিত ফিল্টারযৌগটি দিয়ে ২০০৪ সালের ১৮ মে ফিল্টার করে পরিশোধিত পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পাওয়া গেছে ০.০০১৩ মিলিগ্রাম বা ১.৩ মাইক্রোগ্রাম। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়েও অনেক কম। ফিল্টারটির ব্যবহার দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য শ্যামল চৌধুরী ব্যবহৃত ফিল্টারযৌগটিকে শোষিত আর্সেনিক ও বিষাক্ত খনিজমুক্ত করার 'রিজেনারেশন' পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন। এই পদ্ধতিতে মুক্ত করা আর্সেনিক ও বিষাক্ত খনিজগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে পরিবেশ রার উপযোগী করা হয়। এ ছাড়াও নতুন ও পুরনো নলকূপের পানির নমুনায় আর্সেনিক শনাক্ত করার জন্য তিনি সসত্মায় আর্সেনিক 'টেস্ট কিটস' তৈরি করেছেন যা দেশী-বিদেশী যে কোন ধরনের আর্সেনিক ফিল্টার ব্যবহারকারী দ্বারা এবং গ্রামাঞ্চলের স্কুল কলেজের পরীাগারেও ব্যবহার করা যাবে (বাসস ৮/৮/২০০৯)। এত কিছুর পরও ভূগর্ভস্থ পানি যাতে আর্সেনিকদুষ্ট না হয় তার জন্য কোন প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ফলে দিন দিন ভয়াবহভাবে বেড়ে চলছে পানিতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা ও আক্রানত্ম হচ্ছে দেশের নতুন নতুন এলাকা। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিক এখন শুধু পানিতে সীমাবদ্ধ নেই, তা ঢুকে পড়েছে খাদ্যচক্রে।
গত বছরের শুরম্নর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হকের নেতৃত্বে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের একটি গবেষক দল তাদের গবেষণায় উলেস্নখ করেছে পানির পাশাপাশি শাক-সবজি, কিছু কিছু ধান ও পশুর মাধ্যমে অতিমাত্রায় আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে। উক্ত গবেষণা প্রতিবেদনে সেচের পানি থেকে মাটি, মাটি থেকে খাদ্যবস্তুতে আর্সেনিক সঞ্চালনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। গবেষণা রিপোর্টে উলেস্নখ করা হয়েছে, আর্সেনিককবলিত এলাকায় মাটির উপরিভাগে শূন্য থেকে ১০০ মিলিমিটার গভীরতায়, ১৫০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার গভীরতার তুলনায় অপোকৃত বেশি আর্সেনিক বিদ্যমান। এসব এলাকায় প্রতি কিলোগ্রাম মাটিতে ৮৯ মিলিগ্রাম আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে পানি সেচের কারণে যুক্ত হচ্ছে আরও আর্সেনিক। আর্সেনিকযুক্ত পানি সেচকার্যে ব্যবহারের ফলে ধানসহ বিভিন্ন ফসলে আর্সেনিক জমা হচ্ছে এবং পরবতর্ীতে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে।
অনুসন্ধানী রিপোর্টটিতে দেশে আর্সেনিক দূষণের যে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিমাত্রই দুশ্চিনত্মাগ্রসত্ম হয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভূগর্ভস্থ আর্সেনিকযুক্ত পানি গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে উত্তোলিত হয়ে চাষাবাদে ব্যবহৃত হয় এবং শস্য আর্সেনিক আক্রানত্ম হচ্ছে। আর্সেনিক আক্রানত্ম কৃষিপণ্য খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানব ও বিভিন্ন প্রাণীর দেহে আর্সেনিকোসিসের বিসত্মার ঘটাচ্ছে। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে_ ধান, গম, ডাল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, বেগুন, টমেটো, আলু ইত্যাদি সবজিতে গ্রহণীয় মাত্রার চেয়ে অধিক আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এই চিত্র উদ্বেগজনক। খাদ্যচক্রে আর্সেনিক বিসত্মারের ব্যাপকতা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দেবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশের ভূগর্ভের পানি অতিমাত্রায় আর্সেনিকদুষ্ট হওয়ার মূলে রয়েছে ভূপৃষ্ঠে পানির প্রাপ্যতা হ্রাস। ফারাক্কা বাঁধসহ নানা কারণে ভারত থেকে আসা নদীর পানিপ্রবাহ বিঘি্নত হওয়ার কারণে ভূপৃষ্ঠে পানির অভাব দেখা দেয়ায় দেশের সেচকাজ ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভের পানির অতিব্যবহার ভূগর্ভের আর্সেনিক উপাদানগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। ক্রমাগতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থানে অক্সিজেনের চলাচল শুরম্ন হয়। ভূগর্ভে অবস্থিত আর্সেনিকযুক্ত শিলাখ-ে অক্সিজেনের জারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে পানিতে অজৈব আর্সেনিকের অবমুক্তি ঘটে। মানবসৃষ্ট কিছু কারণেও পানি আর্সেনিকদূষণ হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, বর্জ্য পদার্থ পানিতে অবপেণ, আর্সেনিকযৌগ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত, কাঠের বৈদু্যতিক খুঁটি ব্যবহার মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের মাটিতে বিভিন্ন দূষণ দ্বারা জৈবিক প্রক্রিয়া বেড়ে যাওয়া এবং অন্যান্য কারণে মাটির কণার সঙ্গে লেগে থাকা আয়রন অক্সিহাইড্রোক্সাইড বিজারিত হয়ে পানিতে মিশে যাচ্ছে।
যেভাবেই হোক না কেন আর্সেনিকদূষণ ক্রমান্বয়ে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, এটাই হলো বাসত্মবতা। অবস্থাদৃষ্টে বলতে পারি, খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আর্সেনিকদূষণ অতি তাড়াতাড়ি সর্বগ্রাসী রূপ নেয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো কম সচেতন জনাধিক্যের দেশে আর্সেনিক মহামারী আকার ধারণ করলে ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয় অবধারিত। কাজেই আর্সেনিক সমস্যা থেকে নিসত্মারের উপায় বের করা এখন খুবই জরম্নরী। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে দুটি ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ মাটি থেকে পঁচানব্বই শতাংশ আর্সেনিক শোষণ করে নিতে সম। আবাদকৃত জমির অব্যবহৃত স্থানে আর্সেনিক শোষক উদ্ভিদ রোপণ করা হলে চাষকৃত জমির ফসলকে আর্সেনিক আক্রানত্মের কবল থেকে রা করা সহজ হতে পারে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমাতে হবে। এই েেত্র বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধি, মজা খাল-বিল, নদী-নালা-পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা খুব কষ্টসাধ্য নয়। আমাদের দেশের মানুষ কম সচেতন। তাদের আর্সেনিকের তিকর দিক অবহিত করা হলে এবং আর্সেনিক দূষণ মোকাবেলার পদ্ধতিগুলো শিখিয়ে দেয়া হলে আর্সেনিকের নিয়ন্ত্রণহীন বিসত্মাররোধে সহায়ক হবে। আর্সেনিকদূষণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.