সরকারি উদ্যোগে বেসরকারি 'ছুরি'-ট্যুরিস্ট ও শিক্ষার্থী ভিসায় মালয়েশিয়া পাঠানোর হিড়িক by ওমর ফারুক ও হায়দার আলী

'আমার মোফাজ্জল গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ায় পৌঁছছে। ফোনে কথা হইছে।' মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদককে এভাবেই বলছিলেন যশোরের মণিরামপুর গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের মা তাছলিমা বেগম।
নুরুল ইসলামের ছেলে মোফাজ্জল জাল নথিপত্র দেখিয়ে ট্যুরিস্ট হিসেবে গেছেন মালয়েশিয়া, উদ্দেশ্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করা। একই উদ্দেশ্যে, দর্জি দোকান বিক্রি করে ট্যুরিস্ট ভিসায় এখন মালয়েশিয়ায় আছেন সাতক্ষীরার কলারোয়ার সেলিম মিয়া। তাঁর বাবা বলেন, 'সেলিম মালয়েশিয়া পৌঁছে গেছে। আল্লাহর কাছে ওর জন্য একটু দোয়া কইরেন।'
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেলিম, মোফাজ্জলের মতো ভাগ্যান্বেষী অসংখ্য যুবক এভাবেই মালয়েশিয়া যাচ্ছেন পর্যটক কিংবা শিক্ষার্থী ভিসায়। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে বা তাদের 'ম্যানেজ' করে এভাবে মালয়েশিয়ায় ঢোকা সম্ভব হলেও তাঁদের অনেককে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, এমনটি চলতে থাকলে মালয়েশিয়ায় সরকারি উদ্যোগে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সরকারি প্রক্রিয়াটিকে ব্যাহত করার লক্ষ্য নিয়েও অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন পর্যটক বা শিক্ষার্থী ভিসায় বেকার, কৃষক, শ্রমিক, দোকানিসহ সাধারণ লোকজনকে মালয়েশিয়ায় পাঠাচ্ছে বলেও তারা সন্দেহ করছে।
সাত যুবকের মুখোমুখি : ১৪ জানুয়ারি দুপুর ১২টা। রাজধানীর পুরানা পল্টনে বন্ধু হোটেলের ছয়তলা। একটি কক্ষে ঢুকতেই চোখে পড়ে তিনটি খাটে বসা সাত যুবক। কথা হয় যশোরের মণিরামপুরের নুরুল ইসলামের ছেলে মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। মোফাজ্জল জানান, তিনি কৃষিকাজ করেন। প্রতিবেশী আবুল বাশার তিন লাখ টাকায় মালয়েশিয়ায় পাঠাবেন বলে কথা দিয়েছেন। এখন ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। মোফাজ্জলসহ কক্ষের অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার ৩৪ পুরানা পল্টনের শরীফ প্লাজায় এম আর ইন্টারন্যাশনাল ভিসা জোগাড় করে পাঠানোর কাজটি করছে। বন্ধু হোটেলে জড়ো হওয়া এ যুবকদের বিষয়টি মধ্যস্থতা করছেন প্রতিষ্ঠানটির মো. মনিরুজ্জামান। শর্ত হচ্ছে মালয়েশিয়া পৌঁছার পর তাঁরা বাড়িতে ফোন দেবেন। এরপর স্বজনরা দালালদের হাতে তিন লাখ টাকা তুলে দেবেন। একই কথা বলেন, সাতক্ষীরার কলারোয়ার জুগিখালী এলাকার আব্দুল কাদের মিয়ার ছেলে ইলিয়াস হোসেন ও আব্দুল হকের ছেলে সেলিম মিয়া। তাঁরাও মনিরুজ্জামানের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য হোটেলে উঠেছেন। ট্যুরিস্ট ভিসায় যেতে হলে ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ অনেক নথি লাগে। প্রশ্ন করলে সবার একই উত্তর, সবই ট্রাভেল এজেন্সি জোগাড় করছে। হাত জোড় করে অনুরোধ তাঁরা বলেন, 'ভাই, পত্রিকায় দিলে আমরা মালয়েশিয়ায় যাইতে পারব না।' সেখান থেকে আসার পাঁচ দিন পর খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বন্ধু হোটেলে কথা বলা সেই সাত যুবক মালয়েশিয়ায় বিমানবন্দর অতিক্রম করে নিরাপদেই সে দেশে অবস্থান করছেন।
শ্রমিক হিসেবে কাজ করার লক্ষ্যে প্রতিদিনই লোকজন ট্যুরিস্ট ও স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়া যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একটি চক্র মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধ্বংস করতে কাজ করছে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের বিষয়টি কঠোরভাবে দেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এমনকি মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন বিভাগকে কঠোরভাবে বিষয়টি দেখার জন্য বলা হয়েছে। কেউ যদি ট্যুরিস্ট ভিসার নামে সেখানে যেতে চায়, তাহলে যেন ফেরত পাঠানো হয়।' অসাধু এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্যের ঘটনায় মন্ত্রী অসহায়ত্ব ব্যক্ত করে বলেন, 'একা এত বড় সিন্ডিকেটকে কিভাবে মোকাবিলা করি? এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা দরকার।'
বিএমইটি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) সূত্র জানায়, দেশে সরকার অনুমোদিত ১১ শতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। তারা মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানি করে এসেছে। কর্মীপ্রতি নেওয়া হয়েছে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকারও বেশি। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে বছর চারেক আগে বাংলাদেশ থেকে হঠাৎ জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টার ফলে সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর জন্য গত বছরের নভেম্বরে চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা দুই দেশের উদ্যোগটির বিরোধিতা করে নানাভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে। তবে দালালদের প্রতারণা বন্ধ এবং ৪০ হাজার টাকার মধ্যে সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কঠোর অবস্থান নেন। ইতিমধ্যে সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে নিবন্ধন করা হয়েছে।
প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা : গত এক-দেড় মাসে মালয়েশিয়ায় ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে কয়েক হাজার শ্রমিককে পাঠানো হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে থেকে অনেককে বিমানবন্দর থেকেই বাংলাদেশে ফিরতে হয়েছে। সূত্র মতে, গত ২২ জানুয়ারি ২২ জন এবং ২৩ জানুয়ারি সাতজনকে মালয়েশিয়ার বিমানবন্দর থেকেই ফিরতি ফ্লাইটে তোলা হয়। ২২ জনের একজন বগুড়ার শাজাহানপুরের তড়াইল গ্রামের শাহাদত হোসেন কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, কৃষিকাজ করে তাঁর সংসার ভালোই চলত। মাস দুয়েক আগে রিক্রুটিং এজেন্সির বাচ্চু নামের এক দালাল এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রলোভন দেখান। তিনি ট্যুরিস্ট ভিসা পেয়ে বিমানে চড়ে মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে পৌঁছালেও মালয়েশিয়ায় ঢোকার সুযোগ মেলেনি তাঁর। শ্রমিক সন্দেহ করে তাঁকে ফেরত পাঠায় মালয়েশিয়ার পুলিশ।
২৩ জানুয়ারি যাঁরা ফেরত আসেন তাঁরা হলেন মুন্সীগঞ্জের শেখ ওয়াসিম ও মনির হোসেন, চাঁদপুরের নাজির মাহমুদ, নরসিংদীর নাইম, মুন্সীগঞ্জের নুরুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কামরুল হাসান ও যশোরের রুহুল আমিন। ফেরত আসা শরীয়তপুরের জাজিরার মনির হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি গ্রামে মুদি দোকান চালাতেন। শেখ ওয়াসিম জানান, এক প্রতিবেশীর সহায়তায় তিনি মালয়েশিয়া যান। কিন্তু বিমানবন্দর আর পেরোনো হয়নি।
এজেন্সি অফিসে একদিন : সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আব্দুল কুদ্দুস। সাতক্ষীরা আদালতে মুহুরির কাজ করতেন। বেশি উপার্জনের আশায় মালয়েশিয়ার ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন কুদ্দুস। ফ্লাইটের তারিখ আজ না কাল বলে এক মাস ধরে ঘোরানো হচ্ছে। গত ১৪ জানুয়ারি দুপুর ২টায় কুদ্দুসের সঙ্গে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকও ৩৪ পুরানা পল্টনের শরীফ প্লাজায় রিক্রুটিং এজেন্সি এম আর ইন্টারন্যাশনালে যান। এম আর ইন্টারন্যাশনালে প্রবেশ করে দেখা যায় ছোট ছোট ছয়টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষেই বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের ভিড়। ডান পাশের দুটি কক্ষ পেরিয়ে মো. মনিরুজ্জামানের কক্ষে ঢুকতেই চোখে পড়ে টেবিলে সাজানো সারি সারি পাসপোর্ট। নিজের পরিচয় গোপন করে কথা হয় মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। কুদ্দুসের ভোগান্তির কথা তুলতেই মনিরুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আপনি তো ভাই শিক্ষিত মানুষ, বুঝবেন। এখন মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে খুবই কড়াকড়ি চলছে। থাইল্যান্ডের ভিসা লাগিয়ে চেষ্টা করছিলাম পাঠাইতে, কিন্তু সেখানেও অনেক কড়াকড়ি। ফলে টাকাটা মার যায়। এইবার মালয়েশিয়ার সরাসরি ট্যুরিস্ট ভিসা লাগাইছি, ভিআইপি টিকিটও করে দিয়েছি। আগামী ১৭ জানুয়ারি ইনশা আল্লাহ চলে যেতে পারবে।' মনিরুজ্জামান আরো বলেন, 'বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশকে যাত্রীপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়, সেই টাকা দিলেই আমাদের লোক বিমানবন্দর পাস করতে পারে।' তবে সব কর্মকর্তা ঘুষ খায় না উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান বলেন, 'সরকারিভাবে বিদেশে কত লোকই বা যায়! আমরা ট্যুরিস্ট ভিসায় যাদের পাঠাই, তারা তো সেখানে বসে থাকে না। আর আমরা তো সরকারের ক্ষতি করছি না, তবু আমাদের দুষছে।'
এরপর গত ২০ জানুয়ারি কথা হয় আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী শাহিদা আক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার স্বামী ১৮ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় পৌঁছে গেছে, অনেক কষ্টের পর ভালোয় ভালোয় পৌঁছানোয় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন।'
মামলার ভয়ে নমনীয়তা : শুধু মোফাজ্জল, মাহাবুব, ইলিয়াস আর সেলিমই নন, ট্যুরিস্ট ভিসায় প্রতিদিন মালয়েশিয়া যাচ্ছেন শত শত যুবক। জানা গেছে, অসাধু ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় মোফাজ্জল, মাহাবুব, ইলিয়াস আর সেলিমের মতো সাধারণ ব্যক্তিকে ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাঠাচ্ছে। কাউকে ভিআইপি বিজনেস ক্লাস টিকিট দিয়ে সরাসরি পাঠানো হচ্ছে। পয়সা কম দেওয়া হলে থাইল্যান্ডের ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের রুটও ব্যবহার করা হয়।
সূত্র মতে, জাল সার্টিফিকেট দিয়ে স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করছেন রিক্রুটিং এজেন্সিরই সদস্যরা। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা এসব জাল নথি দেখেই স্টুডেন্ট ভিসা ইস্যু করছেন। এ ভিসাধারীদের কেউ কেউ মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে নেমেই ধরা পড়ছেন এবং ফেরত আসছেন।
এদিকে গোয়েন্দা সংস্থা ও বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক পরিচয়েও চাপ দেওয়া হয়। বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, জাল সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় বিমান থেকে কাউকে নামিয়ে দেওয়া হলে ইমিগ্রেশন পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ কেউ আদালতেও যান। ফলে কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে ট্রলারে করেও মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো হচ্ছে।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের স্পেশাল সুপার নাফিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জেনুইন পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে যখন ইমিগ্রেশন পার হতে আসে তখন কিছু করার থাকে না। তবে যাদের কাগজপত্রে ঝামেলা থাকে, তাদের অফলোড করা হয়।' তবে বিমানবন্দরেরই সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অফলোড করা হলে বিষয়টি আদালতে গড়াতে পারে ভয়ে তাঁরা অনেক সময় সন্দেহভাজনদের আটকানোরও চেষ্টা করেন না।

No comments

Powered by Blogger.