গাইডনির্ভর সৃজনশীলতা? by মো. ইউসুফ আলী

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল কাঠামোর প্রচলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীর সৃজনশীল বিকাশের এটি অন্যতম উপায়। শিক্ষাবিদদের মতামতের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া কমানোর জন্য সৃজনশীল শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতির গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছে।
শিক্ষার্থীর মানসিকতা বিকাশের অন্তরায় হচ্ছে বাজারে প্রচলিত গাইডবই। তাই সরকার গাইডবই নিষিদ্ধ করেছে। সেটি শুধু নিয়ম-কানুনে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে দুই-এক জায়গায় কার্যকর হলেও সারা বাংলাদেশে এখনও গাইড বা নোটবইয়ের ছড়াছড়ি। পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেট ব্লগে অনেকেই এর বিরুদ্ধে লিখছেন। ২০১৩ সালের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। দুই-তিন দিন না যেতেই বাজারে গাইডবই বের হয়। অভিযান চালিয়ে কিছু গাইডবই জব্দ ও জরিমানা করা হয়েছে। এরপর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়েও দেখা যায়, পাঠ্যবই বাদ দিয়ে গাইডবই থেকে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করছে শিক্ষার্থীরা। ঢাকায় ধানমণ্ডির ষষ্ঠ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, 'পাঠ্যবইয়ের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর বই থেকে পাওয়া যায় না। গাইডবইয়ে সুন্দরভাবে সাজানো থাকে।' তাই সে গাইডবই পড়ে এবং তার বন্ধুরাও একই গাইড পড়ে। অন্য এক শিক্ষার্থী উল্লেখ করে, 'বইয়ে দেওয়া নমুনা সৃজনশীল প্রশ্ন থেকে তাদের পরীক্ষায় কমন পড়বে বলে তারা মনে করছে।' এদিকে ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে 'এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি' উপশিরোনামে পৃষ্ঠা নং ৫-এ উল্লেখ রয়েছে, 'আমরা একই পরিমাপের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকি যা প্রচলিত আছে। এগুলো এমকেএস, এফপিএস ও সিজিএস পদ্ধতি নামে প্রচলিত।' এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগে_ এমকেএস, এফপিএস ও সিজিএসের পূর্ণ রূপ কী? কেননা, পৃষ্ঠা নং ১০-এ নমুনা সৃজনশীল প্রশ্ন ২-এ একটি উদ্দীপক দেওয়া হয়েছে এমনভাবে, 'হোসেন উদ্দিন সরকার একজন রপ্তানিকারক। এ বছর তিনি বিদেশে ৫ মেট্রিক টন পাট রফতানি করেন। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঋ.চ.ঝ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও বর্তমানে গ.ক.ঝ পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
(ক) ক্যান্ডেলা কী? (খ) যৌগিক একক ব্যাখ্যা কর। (গ) এ বছর হোসেন উদ্দিন সরকার কত কিলোগ্রাম পাট রপ্তানি করলেন? (ঘ) উদ্দীপকে উলি্লখিত পদ্ধতি দুটির মধ্যে কোনটি সুবিধাজনক? তোমার মতামত বিশ্লেষণ কর।' এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের কোথাও ঋ.চ.ঝ ও গ.ক.ঝ-এর মানে কী তা উল্লেখ করা হয়নি কেন? ফলে শিক্ষার্থীকে গাইডবই দেখতে হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে, উদ্দীপকের সঙ্গে ক্যান্ডেলার কোনো নরূপ সম্পর্ক নেই। যৌগিক একক ব্যাখ্যা করার জন্যও উদ্দীপকটি যথেষ্ট নয়। তাহলে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে উদ্দীপক ও প্রশ্নের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকা কি উচিত নয়? ওপরের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আগের নিয়মেই মুখস্থনির্ভর উত্তর চাওয়া হচ্ছে, যা সৃজনশীলতা বিকাশের অন্তরায়। নমুনা সৃজনশীল প্রশ্ন এমনভাবে করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীকে গাইডবইয়ের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এ জন্য পাঠ্যপুস্তককে আরও সমৃদ্ধ করা আবশ্যক। বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ে ব্যবহৃত শব্দ বা শব্দগুচ্ছের স্পষ্টতা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সৃজনশীল কাঠামোকে অনুসরণ করা উচিত। অসামঞ্জস্য উদ্দীপক শিক্ষার্থীকে গাইডবইয়ের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে, যেটি শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশের অন্তরায়।
য়এমফিল গবেষক, আইইআর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
yousufier@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.