গ্রন্থমেলা আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবিঃ প্রধানমন্ত্রী by শফিকুল ইসলাম

অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরিসর বাড়ানোর তাগিদ জানিয়ে মাসব্যাপী গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেলা উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমীতে স্থান সঙ্কট।
অতএব একাডেমীর পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলা আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। একুশের ইতিহাস বাঙালির গৌরব ও বীরত্বের ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আমরা রক্ত দিয়ে মাকে মা বলে ডাকার অধিকার অর্জন করেছিলাম। অমর একুশে বইমেলা আমাদের সেই গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। মেলার উদ্বোধন শেষে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী।

এ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিােভ মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। তাদের মোকাবেলায় ছাত্রলীগও সকাল থেকেই সশস্ত্র মহড়া দেয়। অন্য দিকে গতকাল শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন থাকায় গ্রন্থমেলায় লেখক-দর্শকসমাগম ছিল প্রচুর। কিন্তু গ্রন্থমেলার স্টলগুলোতে এখনো বই সাজানোর কাজে ব্যস্ত প্রকাশক ও কর্মচারীরা। গতকাল মেলা উদ্বোধনের পর এ দৃশ্য চোখে পড়ে।

বাংলা একাডেমীর সভাপতি এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এবং গ্রন্থমেলার সদস্য সচিব শাহিদা খাতুনের উপস্থাপনায় গ্রন্থমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রকাশক প্রতিনিধি মহিউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ অনুকৃতি করেন খুলনার একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র শাবাব সায়েম। পরে খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রী সায়েমের নামে এক লাখ টাকার একটি ফিক্স ডিপোজিট করার ঘোষণা দেন। মেলা উদ্বোধন কালে মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শিাবিদ, কবি-সাহিত্যিক, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশকসহ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।

মেলার উদ্বোধন : গ্রন্থমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের পর পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত, গীতা পাঠ ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা হয়। এরপর একুশের সঙ্গীত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… গেয়ে ওঠে সমবেত সঙ্গীত। পরে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।

মেলার পরিসর বাড়ানোর তাগিদ : অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরিসর বাড়ানোর তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমীতে স্থান সঙ্কট রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ, ফোয়ারা। উদ্যানে যে বড় মাঠ রয়েছে সেখানেই আয়োজন করা যেতে পারে বাংলা একাডেমীর বই মেলা। এতে মেলায় অনেকেই আসতে পারবেন এবং মেলার পরিসরও বাড়বে। একাডেমী মহাপরিচালকের মতের সাথে একমত পোষণ করে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা করার ওপর মত দেন। এ সময় উপস্থিত অনেকেই করতালি দিলে তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মন্তব্যের পর এখানে উপস্থিত অনেকেরই মনের কথা হয়তো প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলা একাডেমীতে মেলার আয়োজন না করে এখানে ?বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে।

আগের মতো স্বাধীনভাবে বইমেলায় ঘুরতে না পেরে দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ মেলায় কবি-সাহিত্যিক, লেখক, পাঠকেরা স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারেন। বই ধরে দেখেন। কিন্তু আমি এখন আর স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারি না। এটি আমার একটা দুঃখ। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, একুশ আমাদের গৌরব। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমাদের মানুষ রক্ত ঢেলে দিয়েছে। বইমেলা গৌরবের ইতিহাসকেই প্রতিভাত করে। লেখক, সাহিত্যিক ও পাঠকদের এক বিরল সুযোগ এনে দেয় এ মেলা।

তিনি আরো বলেন, ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগিয়ে নিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে আমরা বীরের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি এখনো সক্রিয় এবং ফের আমাদের ওপর আঘাত হেনেছে। তাদের বিরুদ্ধে এখনো আমাদের সংগ্রাম চলছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাভাষাকে আরো সমৃদ্ধশালী করতে দেশের লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের বই ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের বইও বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। অন্য ভাষার চর্চা করলে মাতৃভাষা বিলুপ্ত হবে না, বরং সমৃদ্ধ হবে। বাংলা একাডেমীকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া চলতি সংসদ অধিবেশনেই বাংলা একাডেমীর জন্য আইন পাস হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, আগে আমার ছেলেমেয়ে-বৌ বাইর থেকে এলে অনেক বই নিয়ে আসত। এখন নিয়ে আসে একটি নোট বুক বা আইপ্যাড। আইপ্যাডে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব বই পড়তে পারে তারা। এসবে এখন অনেক সুবিধা। তিনি বলেন, আমাদের আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হতে হবে। আবার কাগজের বইও থাকতে হবে।

কারণ বই ধরে যে আনন্দ, যে ঘ্রাণ তা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। আমি নিজেও বই পড়ার সময় না পেলেও ধরে দেখি। উদ্বোধনী বক্তব্য শেষে বইমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলা একাডেমীর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ ও সৃজনচেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা তার ৩০ বছরে যেমন বাংলা একাডেমীর ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, তেমনি আমাদের সামগ্রিক অস্তিত্বের সাথেও মিশে গেছে।

একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, এবারের মেলা আর বারোয়ারি নয়, শুধু লেখক আর প্রকাশকদের। তিনি বলেন, বৈশ্বিকভাবে বাংলা ভাষার বিস্তার ও তৃণমূলের বিস্তারে কাজ করছে বাংলা একাডেমী।

গ্রন্থমেলা উদ্বোধনের পরপরই শুরু হয় নিয়মিতভাবে লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের বইয়ের মোড়কের উন্মোচন। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে জমে উঠেছে বইমেলা।

মেলামঞ্চে আজ : আজ শনিবার গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে ‘অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। অংশ নেবেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, আতিউর রহমান, এম এম আকাশ ও মাসুদা ভাট্টি। সভাপতিত্ব করবেন ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ। সন্ধ্যায় পরিবেশিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
       

No comments

Powered by Blogger.