মাদ্রিদে তিন বাঙাল by মুনতাসীর মামুন

আমি তো কৌতূহল চেপে রাখতে পারছি না। বললাম, নেবেনই যখন তখন ব্যাপারটা খোলাসা করম্নন। প্রস্তুতি নিয়ে থাকব। তো স্যার খানিকৰণ চুপ করে থাকলেন।
তারপর আমতা আমতা করে বললেন, কলকাতায় থাকার সময় তার প্রেম হয় ভিন্নধর্মী এক মেয়ের সঙ্গে। প্রেম বলে প্রেম, একেবারে বিয়ের কাছাকাছি। কিন্তু কোন পরিবারই রাজি নয়। সবাইকে এত গররাজি দেখে মেয়েটি পিছিয়ে যায়। তারপর ১৯৪৭। তিনি চলে আসেন ঢাকায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজ ২৫ বছর পর ফিরেছেন কলকাতায়। এখন তার খুব মনে পড়ছে মেয়েটির কথা।'
সত্যি মানুষের মন। হদিস মেলাই ভার, ভাবি আমি। মনির ভাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। হাশেম ভাই একটু থেমে আবার শুরম্ন করেন_
'আমি জিজ্ঞেস করলাম, সবইতো বুঝলাম স্যার। কিন্তু আপনি কি তার খোঁজ জানেন? ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন, কোথায় খোঁজ করব?
স্যার বললেন, আমি খোঁজখবর নিয়েছি এবং তার খোঁজ পেয়েছি। একটু লাজুক হেসে বললেন, তাকে ফোন করেছিলাম, কাল যাব বলেছি।'
গল্প জমে উঠছে। হাশেম ভাই নিজেই মজে গেছেন গল্পে। মনির ভাই বললেন, 'মুনতাসীর প্যাকেটটা কই?' অর্থাৎ, ডিউটি ফ্রি বেনসন। প্যাকেটটা এগিয়ে দিই। সিগারেট ধরিয়ে ভিনুর গস্নাসে এক চুমুক দিয়ে শেষ করেন। বোতল থেকে ভিনু ঢালেন গস্নাসে। আমাদের গস্নাসে তখনও অর্ধেক ভিনু। হাশেম ভাইও এই ফাঁকে গস্নাসে চুমুক দিয়ে যেন তরতাজা হয়ে ওঠেন।
'পরদিন বিকেলে রেডিটেডি হয়ে স্যারকে বললাম চলেন। স্যার আগেই পরিপাটি হয়ে রেডি। হেঁটেই রওনা হলাম। স্যারের রাসত্মাঘাটের কথা তখনও বেশ মনে আছে। এদিক সেদিক দিয়ে চললেন। এক রাসত্মার ফুটপাতে ডালি সাজিয়ে বসে কয়েকজন ফুল বিক্রি করছিল। স্যার বেছে বেছে দু'টি তাজা গোলাপ কিনলেন। তারপর সলজ্জ হেসে বললেন, দু'টি ফুল নিই হাশেম। বললাম, অবশ্যই। স্যারের এই ট্রান্সফর্মেশন দেখে অবাক লাগছিল। দুঃখও লাগছিল। তারপর আরো মিনিট কুড়ি এগলি সে-গলি পেরিয়ে আরেক গলিতে এক বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কলিং বেল টিপলেন স্যার।'
হাশেম ভাই একটু থামলেন যেন দম নেয়ার জন্য। ভিনুর গস্নাসে চুমুক দিলেন। মনির ভাই আনমনে সিগারেট টানছেন।
'কেউ দরজা খুলছে না। আরেকবার কলিং বেল টিপলেন। এবার শব্দ পাওয়া গেল। মনে হলো দুরদার করে সিঁড়ি ভেঙ্গে দরজা খুলতে কেউ এগিয়ে আসছে। দরজা খুলে দিল এক তরম্নণী। স্যার ফুল দু'টি পেছনে লুকিয়ে রেখেছেন। অচেনা দু'জন মানুষকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তরম্নণী জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
স্যার নাম বললেন, কার সঙ্গে দেখা করতে চান তাও বললেন। মেয়েটি বোধহয় কলেজে পড়ে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মা আপনাদের চেনেন? স্যার বললেন, বল গিয়ে তোমার শফিক কাকু এসেছেন।
মেয়েটি তখন দরজা খুলে দিয়ে বলল, আসেন আসেন। বাড়িটি দোতলা। একতলায় বসার ঘর। আমাদের বসিয়ে মেয়েটি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। আমরা বসলাম। সত্যি বলতে কি, তখন খুব অস্বসত্মি লাগছিল। স্যার যে চলে এলেন, মহিলা বিবাহিত, সনত্মান আছে। স্বামী আছে। কী অবস্থা হয় কী জানি।
দেখি, স্যারও বেশ টেনশনে আছেন। গোলাপ দু'টি পেছনে রাখা। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় মাঝ বয়সী সুন্দরী এক মহিলা তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।'
হাশেম ভাই বোধহয় কাইমেক্সের জন্য চুপ করে গেলেন। ভিনুর গস্নাসে চুমুক দিয়ে গস্নাস শেষ করলেন। মনির ভাই, হাশেম ভাইয়ের গস্নাস আবার ভরে দিলেন। হাশেম ভাই সাধারণত আধা গস্নাসের বেশি নেন না। এবার আপত্তি করলেন না। তিনি নিজেও এখন নস্টালজিয়ায় আক্রানত্ম। মনির ভাই বললেন, 'হঁ্যা, বলেন।'
'মহিলা প্রায় ছুটে আসছিলেন,' বললেন হাশেম ভাই, 'আমাকে দেখে একটু থমকে দাঁড়ালেন। শফিক স্যার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার ছাত্র হাশেম। তারপর গোলাপ দু'টি সামনে এনে মহিলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মহিলার চোখে মুগ্ধতা, এ বয়সেও যেন গালে লালের ছোপ পড়ল। মৃদু কণ্ঠে শুধু বলতে পারলেন, আমার জন্য?'
স্যার হেসে বললেন, 'হঁ্যা'।
'এখন মুশকিল হলো,' হাশেম ভাই গস্নাসে চুমুক দিয়ে বললেন, 'নিজেকে নিয়ে আমি কী করি। আমি সামনে থাকলে তারা কথা কী বলবেন। কী করব বুঝতে পারছি না',
'মুনতাসীর সিগারেট', মনির ভাই গল্প শুনতে শুনতে বললেন, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দিলাম। 'এমন সময় দেখি,' বললেন হাশেম ভাই, 'মেয়েটিও সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামছে। পেছনে এক ভদ্রলোক। মুখে মৃদু হাসি। বুঝলাম, মেয়েটির বাবা।'
ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালে মহিলা পরিচয় করিয়ে দিলে বললেন, 'আমার স্বামী। আর ইনি শফিক দা।'
ভদ্রলোক খুব অমায়িক। স্যারের হাত জড়িয়ে ধরে পাশে বসালেন। স্যার আমার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। সামান্য আলাপের পর তিনি আমায় বললেন, চলেন তো আমার সঙ্গে ওপরে। জম্পেশ করে বাংলাদেশের কথা শোনা যাবে। আমাকে নিয়ে প্রায় টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলেন। মেয়েকে বললেন, যাও তো মা, চাটা বানাও, কাকুরা এসেছেন।
ভদ্রলোক আমাকে তাদের শোবার ঘরে নিয়ে বসালেন। বুঝলাম, তিনি আমাকে ও তার মেয়েকে সরিয়ে দিলেন। হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, 'বসেন বসেন। ও আমাকে সব বলেছে। এতদিন পর ওদের দেখা। শানত্মিতে ওদের একটু গল্প করতে দেন।'
গল্প টল্প শেষে বিদায় নিয়ে স্যারসহ বেরম্নলাম। তাকে দেখেই বুঝলাম, মন তার খুশিতে টইটুম্বুর। আমাকে শুধু বললেন, 'হাশেম তোমার আপা যেন না জানে।'
'আহ্ দিল মে চাক্কু', বললেন মনির ভাই, 'কী যে শোনালেন হাশেম ভাই।'
আমরা নীরবে গস্নাসে চুমুক দিই। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এরকম কত গল্প চাপা পড়ে আছে। চাপা দিয়ে অন্য জীবন যাপন করি। মাঝে মাঝে রক্তৰরণ হয়। এই তো মানুষের জীবন। 'না, কাহিনীর এখনও শেষ হয়নি।' নীরবতা ভাঙ্গলেন হাশেম ভাই।
'হাশেম ভাই, এটা ছোট গল্প। উপন্যাসের দরকার নেই।'
'না না উপন্যাস করছি না। গল্পের শেষটুকু বলছি।"
ঢাকায় ফিরেছি। কলকাতার কথা প্রায় ভুলে গেছি। আপা মানে স্যারের স্ত্রী মানে শাহাদতের বড় বোন আমাকে ডেকে পাঠালেন। প্রমাদ গুণলাম। বুঝলাম কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে। যা হোক গেলাম স্যারের বাসায়। স্যার ছিলেন না। আপা কোনরকম ভনিতা না করে আমাকে বললেন, 'হাশেম তুমি আমাকে সত্য কথা বলবে।' বললাম, 'কী বিষয়ে সত্য বলতে হবে বলেন। আপা তখন কলকাতার সেই মহিলার কথা তুলে বললেন, ওর সঙ্গে তোমাদের কলকাতায় দেখা হয়েছে? বললাম, সেটা আমাকে কেন স্যারকে জিজ্ঞেস করম্নন। বললেন, স্যারকে জিজ্ঞাস করতে হবে না। বুঝলাম উনি বিষয়টি জেনেছেন। আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তা ঐসব সূৰ্ন অনুভূতির কি তিনি ধার ধারেন?'
'কিন্তু আপা জানলেন কীভাবে?' জিজ্ঞেস করি আমি।
'জানি না,' বললেন হাশেম ভাই, 'আমি আর স্যারকে এসব জিজ্ঞেস করিনি।'
'আমরা গ্রেসফুলি কোন কিছু করতে পরি না,' সিদ্ধানত্ম দেয়ার ভঙ্গিতে বলি আমি, 'মহিলারা তো নয়ই।'
'আরেক রাউন্ড ভিনু চলবে নাকি?' মনির ভাই জিজ্ঞেস করেন, আমরা মাথা নাড়ি। 'কফি?' মনির ভাইয়ের ফের আপ্যায়নের চেষ্টা।
'পাগল নাকি।' বলি আমি, ঘড়ির দিকে তাকাই। সাড়ে বারোটার ঘর পেরম্নচ্ছে। বললাম, 'আমি গুডবাই জানাচ্ছি।'
'গুডবাই,' বললেন, মনির ভাই, 'হাশেম ভাই বসেন। গণিস্কুলের কথা তো মনে আছে আপনার?'
দু'জনের আবার চাঁদপুরের গল্প শুরম্ন হলো।
১৫
যত রাতেই ঘুমোই না কেন সকাল সাত থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে ঘুম ভাঙ্গবেই। আধো অন্ধকারে আরো খানিকৰণ গড়াগড়ি খাই। হাশেম ভাই নেই, বোধহয় বাথরম্নমে। একসময় আর শুয়ে থাকা যায় না। উঠে পড়লাম। দেখি হাশেম ভাই নিবিষ্ট মনে পেঁয়াজ টমেটো আপেল কমলা ইত্যাদির সংমিশ্রণে, তাঁর মতে, সুস্বাদু ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যসত্ম। বললাম, 'স্বাস্থ্য রৰায় এত পরিশ্রম করতে হলে বেঁচে থাকার আনন্দ কোথায়?' হাশেম ভাই এক গাল হেসে বললেন, 'না না ব্রেকফাস্টটা খুবই সুস্বাদু। তুমি একবার চেখে দেখতে পারো।'
'আমার রম্নটি কফিই ভাল। সিম্পল ফুড আর হাই থিংকিংয়ের পথই আমি অনুসরণ করি', বললাম আমি, 'কতৰণ জাগলেন?'
'না, বেশিৰণ না, একটা দেড়টা পর্যনত্ম', জানালেন হাশেম ভাই।
আমি স্নানটান করে, নোজা গেঞ্জি রম্নমাল ইত্যাদি ধুয়ে ধীরে সুস্থে বাথরম্নম থেকে বেরম্নলাম। এগুলি শুকোতে দিতে হবে। বারান্দার রেলিংয়ে কাপড় শুকোতে দেয়া যাবে না। পৌর কর্তৃপৰ জরিমানা করবে। এই ফ্যাটের খাবার ঘরের জানালা থেকে বেডরম্নমের জানালা পর্যনত্ম ফাঁকা দড়ি টাঙানো আছে। এসব ফ্যাটে এ ধরনের ব্যবস্থা থাকে। ফ্যাটের ভেতর দিকটায় জানালা টু জানালা দড়ি। জানালার কাছে ছোট একটা কপিকল। কাপড় জামা কিপ দিয়ে দড়িতে আটতে এক প্রানত্ম টানলে কাপড়গুলি মাঝামাঝি চলে যায়। সেখানে সূর্যের আলো পড়ে। এই পদ্ধতিতে সব শুকোতে দিয়ে রম্নটি, মাখন, জেলি আর কফি দিয়ে নাসত্মা সারলাম। রম্নমে এসে দেখি হাশেম ভাই রেডি। আমার আলসেমি লাগছিল। বললাম, 'মাসুম ফোন করম্নক, তারপর রেডি হয়ে বেরম্ননো যাবে।' বলে, আমি আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছিল না আমাদের। ন'টার দিকে ফোন এলো মাসুমের। তার ডাবল শিফট পড়ে গেছে। সকালে বেরম্নতে পারছে না। বিকেলে অল্পৰণের জন্য ছুটি পাবে তখন সে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিছু না ভেবেই বললাম, 'বিকেল চারটের দিকে স্টেশনে এসো।' আসলে অবচেতনায় টাকা ভাঙানোর ব্যাপারটা বোধহয় মাথায় ছিল। আর ভাঙাবো তো স্টেশনে। সে কারণেই বলা। বললাম, 'হাশেম ভাই, অতঃপর?'
'মনির উঠুক,' বললেন হাশেম ভাই, 'ও কে না বলে তো আর বেরম্ননো যাবে না।'
কথা শেষ হতে না হতেই দরজায় হাফপ্যান্ট ও খালি গা মনির ভাইয়ের আবির্ভাব। বললাম, 'কী ব্যাপার উঠে গেলেন?'
'হঁ্যা, দেরি হয়ে গেল', 'ঘুমের জড়তা তখনও ভাঙ্গেনি, 'কালকে রাতে কাজ করেছি।'
'কখন?'
'হাশেম ভাই ঘুমাতে যাওয়ার পর মুড এল, তিনটা পর্যনত্ম কাজ করেছি। তাই উঠতে দেরি হলো। আপনারা নাসত্মা করছেন?'
'অনেক আগে,' বললেন হাশেম ভাই, 'তোমার ব্যসত্ম হবার কিছু নাই।'
'যাইবেন কই?' জিজ্ঞেস করেন মনির ভাই।
'ঠিক করি নাই, তুমি বাথরম্নমে ঢোক। নাসত্মাটাসত্মা করো, তারপর ঠিক করব।'
'না আমি নাসত্মা খাই না।' জানালেন তিনি, 'তা হইলে অপেৰা করেন।'
মনির ভাই গেলেন। হাশেম ভাই গুনগুন করতে করতে তাঁর স্বল্প কেনা জিনিসপত্র আবার গোছগাছ করতে লাগলেন। আর আমি আমার প্রিয় হবি ঘুমানোতে মনোনিবেশ করলাম।
সাড়ে দশটার দিকে মনির ভাই উঁকি মারলেন। পোশাক আশাক পরে রেডি। বললেন, 'চলেন।'
'মানে?' জিজ্ঞেস করি আমি।
'আইজ আপনাগো লগে বাইর হমু।' ঘোষণা দিলেন তিনি।
'আরে না মনির,' হাশেম ভাই, বোঝাবার চেষ্টা করলেন, 'তোমার না কাজ আছে। আমাদের জন্য সময় নষ্ট করার দরকার নাই। আমরা নিজেরাই চড়ে বেড়াতে পারব।'
'থোন আপনার কাজ কাম। চলেন।'
অগত্যা আমরা তিনজনে বের হই। মনে হলো বেশ খোশমেজাজে আছেন। লিফট নিচে নামতেই সেই মহিলা এগিয়ে এলেন। মনির ভাই ও তিনি স্মিতহাস্যে কুশল বিনিময় করলেন। দরজা খুলে বেরম্নতেই ঝলমলে সকাল। সাড়ে দশটা বাজে। এখনও সূর্য তপ্ত হয়ে ওঠেনি।
ফ্যাটের উল্টো দিকে একটি বার। কফিও পাওয়া যায়। আশপাশের অফিস থেকে অনেকে যাচ্ছেন বারের দিকে। সুবেশী এক মধ্যবয়সী নারী বার থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে আসছিলেন। সামনাসামনি হতেই, 'আ মনির' বলে সম্বোধন করলেন। দু'জনে গালে গাল মেলালেন। মিনিট দুয়েক তারা আলাপ করলেন। মনির ভাই বললেন, 'আমার লইয়ার। পাশের ফ্যাট বাড়িতে অফিস।'
আমরা বারে ঢুকলাম। মোটামুটি ভিড়। এখন কফি ব্রেক। যারা সকালে নাসত্মা না করে এসেছে তাদের অনেকে বসে নাসত্মা করছে। আমরা বারটুলেই বসলাম। ওয়েটার এলে, মনির ভাই বললেন, 'এসপ্রেসো।'
'কাফে অউলাত', নিজের অর্ডার দিলাম।
ওয়েটার মনির ভাইয়ের চেনা। প্রায়ই বোধহয় তিনি আসেন। ঝটপট কফি চলে এল। কফি খেতে খেতেই দেখলাম, লোকজনে ভরে উঠছে বার। কফি ব্রেকের এটা বোধহয় পিক আওয়ার।
কফি শেষ করে আমরা বেরম্নলাম। সেই পুরনো রাসত্মা ধরে সোলের দিকে এগুতে লাগলাম। রাসত্মাঘাটে বেশ মানুষজন দেখা যাচ্ছে। ১৮০৮ সালের ২রা মে নেপোলিয়নের এক সেনাপতি মুরা মাদ্রিদের এই পুয়ের্তা দেল সোল দখল করে নেন। এটাই শহরের কেন্দ্র। গোইয়া থাকতেন এখানের এক অট্টালিকায়। ফরাসী সেনাদের ওপর আক্রমণ করে তখন অসংগঠিত স্বেচ্ছাসেবীরা। গেরিলা শব্দটির উদ্ভব তখনই। পরবর্তী শতকে এই শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরের দিন রাতে আরেক ফরাসী সেনাপতি গ্রম্নশি গেরিলাদের খুঁজে খুঁজে সারারাত চালান গণহত্যা। গোইয়া তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে গণহত্যা দেখেন। তাঁকে খুব নাড়া দিয়েছিল এই গণহত্যা। পরবর্তীকালে এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে অাঁকেন তিনি 'মুরার সঙ্গে গেরিলাদের যুদ্ধ' বা 'তেসরা মের গণহত্যা' নামে বিখ্যাত ছবিগুলি।
আমরা সোলের চৌরাসত্মায় পেঁৗছে যাই। গতকাল এখান থেকেই মাসুম ট্যাক্সি করে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল প্রাসাদ দেখাতে। চারদিকের অবস্থা পর্যবেৰণ করে হাশেম ভাই জানালেন এখানে ছবি তুলতে হবে।
এরপর শুরম্ন হলো হাশেম ভাইয়ের কম্পোজিশন ঠিক করার পালা। কোন কম্পোজিশনই ঠিক হয় না। একটা কম্পেজিশন মনোমত হওয়ার পর মনির ভাইকে আবার দেখালেন। মনির ভাই আবার একটুু এদিক সেদিক করলেন। একবার আমি হাশেম ভাই, একবার আমিও মুনির ভাইয়ের ছবি তোলা হলো। এবার নির্দেশ এল তাদের দুইজনের ছবি তুলে দেয়ার। এবার মনির ভাই কম্পোজিশন ঠিক করলেন। আমি দ্বিরম্নক্তি না করে কিক করলাম। যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। কিন্তু, আমাদের তিনজনের তো এক সঙ্গে একটি ছবি তোলা উচিত। মনির ভাই পথচারীদের পর্যবেৰণ করতে লাগলেন। এক মহিলা দ্রম্নত হেঁটে যাচ্ছিলেন। মনে হলো না স্পেনিশ। মনির ভাই তাকে থামালেন। হাসি খুশি মহিলা নিমিষেই বুঝে নিলেন আমাদের বাসনা। মনির ভাই দ্বিরম্নক্তি না করে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। মহিলা জানালেন তিনি আমেরিকান। স্পেনে আছেন কিছুদিন, কাসত্মিলিয়ান শিখবেন বলে। মনির ভাই নিজের পরিচয় দিলেন। তা আর্টিস্টদের কে না পছন্দ করে। মহিলার হাসি আরও বিসত্মৃত হলো। বললেন, 'দাও দাও ছবি তুলে দিচ্ছি।' মনির ভাই বললেন, 'তুমি আগে এই দু'জন বিখ্যাত লোকের পাশে দাঁড়াও। একটি ছবি তুলি।' হাসিমুখে তিনি পোজ দিলেন আমাদের সঙ্গে। আমি বললাম, 'এই মুহূর্তটিকে অমর রাখতে শিল্পী হাশেম খানের সঙ্গে এই মহিলার একটি ছবি তোলা দরকার।'
'সি সি' বলে মনির ভাই সম্মতি দিয়ে বললেন, 'হাশেম ভাই দাঁড়িয়ে যান। আহ, আরেকটু পাশে আসেন না। হাতটা দিয়ে একটু জড়িয়ে ধরেন না, 'মনির ভাই ক্রমশ নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন, হাশেম ভাই ইতসত্মত করছেন, 'আহ, কেউ নেই এখন, ঝটপট করম্নন', হাশেম ভাই এক হাত মহিলার কাঁধে রাখেন, তিনিও তার হাত হাশেম ভাইয়ের পিঠে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে কিক কিক। আমরা সবাই এরপর হাসতে শুরম্ন করি। মহিলা বললেন, 'এইবার তোমাদের একটা ছবি তুলে দিই', আসলে আমরা যে আমাদের ছবি তোলার জন্য তাকে দাঁড় করিয়েছিলাম, হাসি ঠাট্টার কারণে তা ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, 'আমার ক্যামেরায় তুলে দিচ্ছি।' আমরা তিনজন দাঁড়ালাম। ঝটপট কয়েকটি স্ন্যাপ নিলেন। মনির ভাইকে অনুরোধ করলেন, তার ক্যামেরায় আমাদের সঙ্গে ছবি তুলে দিতে। তারপর মনির ভাইয়ের সঙ্গে ই-মেইল বিনিময় হলো। বিদায় নেয়ার সময় মহিলা জানালেন, ই-মেইলে তিনি ছবি পাঠিয়ে দেবেন। 'তাই ভরসা', বললাম, আমি, 'আমাদের ছবি আপনাদের ক্যামেরায় নেই, আছে তার ক্যামেরায়।'
'সত্যিই তো ভুল হয়ে গেল।' বললেন হাশেম ভাই।
'আচ্ছা ভেবে দেখুন তো' হাঁটতে হাঁটতে বললাম, 'মাদ্রিদের রাজপথে এই সকালে আমরা চাঁদপুরের তিনজন_ভাবতেই অবাক লাগছে_থ্রি চাঁদপুরিয়ানস ইন মাদ্রিদ।'
'হঁ্যা মামুন ভাল বলেছ। এই নিয়ে একটা লেখা জনকণ্ঠের স্বদেশকে পাঠালে কেমন হয়, স্রেফ মজা করার জন্য।'
'খুবই ভাল প্রসত্মাব', মনির ভাই সায় দেন।
'উত্তম, আমিও সমর্থন করি', রাতে ফিরে লিখে ই-মেইল করে স্বদেশকে একটা ফোন করে দেয়া যাবে।'
কয়েক মিনিট হাঁটার পর আমরা পাথুরে এক ভবনের সামনে এসে দাঁড়াই। 'এটি হলো কালকো গ্রাফিয়া ন্যাসিওনাল।' জানালেন মনির ভাই, 'স্পেনের গ্রাফিকস যারা করেন তাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এটা দেখে যান, একটা অভিজ্ঞতা।'
মনির ভাই প্রধানত গ্রাফিকস শিল্পী। সুতরাং জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকা স্বাভাবিক।
আমরা সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে লাগলাম।
দোতলায় এক অফিস ঘরে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন মনির ভাই। টেবিলে ঝুঁকে এক ভদ্রলোক এক মনে কী কাজ করছেন। মনির ভাইয়ের সম্ভাষণে চমকে উঠলেন ভদ্রলোক। মনির ভাইকে দেখে যেন বিস্মিত হলেন। তারপর সোলস্নাসে 'আহ মনির' বলে ডেস্ক ছেড়ে এগিয়ে এলেন, জড়িয়ে ধরলেন মনির ভাইকে। তুমুল কাসত্মিলিয়ানে আলাপ শুরম্ন হলো দু'জনের। বোঝা গেল বহুদিন মনির ভাই এদিকটায় আসেননি। এরি মধ্যে মনির ভাই বাংলাদেশের 'বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও লেখক' এবং 'বিখ্যাত শিল্পী'কে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক যেভাবে সমীহ ভরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন তাতে মনে হলো তিনি ঠিক ঠিকই মনির ভাইয়ের কথায় বিশ্বাস করেছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হলে দু'জনে আবার তুমুল কাসত্মিলিয়ানে বাতচিত শুরম্ন করলেন। এক কোণে বেশ কিছু প্রিন্ট সাজানো। প্রত্যেকটির গায়ে দাম লেখা আছে। তাতে মনে হলো, এগুলি বিক্রির জন্য। মনির ভাইয়ের প্রিন্টও আছে। এগুলির দাম ১৫০ থেকে ২৫০ ইউরোর ভেতরে। যার সঙ্গে মনির ভাই আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি কালকো গ্রাফিয়ার পরিচালক। মনির ভাই জানালেন, সময়ে সময়ে এখানে বিখ্যাত গ্রাফিকস শিল্পীরা ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন নবীন শিল্পীদের জন্য। মনির ভাইও করেছেন। ভেতরে প্রিন্ট করার বন্দোবসত্ম আছে। স্বাভাবিকভাবে স্পেনের প্রথম সারির শিল্পী হিসেবে মনিরম্নল ইসলাম এখানে আদ্রিত। পরিচালকের সঙ্গে আলাপ শেষে মনির ভাই বললেন, 'চলেন ভেতরটা দেখাই।' পরিচালকের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কী ভেবে তিনি আমাদের একটু অপেৰা করতে বললেন। ফিরে এলেন দু'টি বই নিয়ে। স্পেনের গ্রাফিকস শিল্পীদের প্রিন্টের প্রতিলিপির সংকলন।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.