পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প নেই by ডা. এম এ করীম

সম্প্রতি জাপানে ভয়াবহ ভূমিকম্প, সুনামি এবং এগুলোর জের ধরে পারমাণবিক চুলি্লতে বিস্ফোরণের ফলে অনেক পরমাণুবিদ্বেষী পরমাণু বিদ্যুতের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা শুরু করেছেন। বাংলাদেশেও কিছু ব্যক্তি এর সঙ্গে সুুর মেলাচ্ছেন।


আমরা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কিছু বিচার না করেই 'বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা'র তত্ত্ব নিয়ে চলছি। আশির দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে যখন পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প জাতীয় চাহিদা হিসেবে দেখা দেয়, ঠিক তার পরই 'চেরনোবিল' পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে এবং ওই দুর্ঘটনার পর সব কিছু ভেস্তে যায়। তখনো দেখা গেছে, এ দেশে পরমাণু বিদ্যুৎবিরোধী কিছু ব্যক্তি ও বিজ্ঞানীকে সোচ্চার হতে। কিন্তু এসব পরমাণু বিদ্যুৎবিরোধী জানতেন, চেরনোবিল পাওয়ার রি-অ্যাক্টর সব দিক থেকে ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তখনো কিন্তু সারা বিশ্বে কয়েক হাজার রি-অ্যাক্টর, বিশেষ করে '৪৫০' পাওয়ার রি-অ্যাক্টর সুষ্ঠুভাবে চলেছে। ঠিক আজ যে সুনামিতে জাপানি 'পরমাণুু বিদু্যুৎ প্লান্ট' ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাও কিন্তু সেকেলে। তবুও ওই ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে জাপান। হয়তো অনেকে বলবেন, জাপান বলে তা সম্ভব হয়েছে। তাঁরা এও বলবেন, জাপানে যা সম্ভব, এখানে তা অসম্ভব; বিশেষ করে পরমাণু বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। আমি বলব, মোটেই তা অসম্ভব নয়। আমাদের দেখতে হবে, এ দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব কিভাবে। আমাদের ভাবতে হবে জ্বালানির অন্যান্য উৎস নিয়েও। বাংলাদেশে জ্বালানির অন্যতম উৎস হলো গ্যাস। ৬৬ শতাংশ জ্বালানি আসে গ্যাস থেকে। গ্যাসের রিজার্ভও ফুরিয়ে আসছে। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা এখন ৩১ শতাংশ। কয়লার সম্ভাবনা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র এক শতাংশ। পৃথিবীতে যেসব 'এনার্জির উৎস' আছে, সেগুলোর মধ্যে কয়লা, পরমাণু বিদ্যুৎ, জল বিদ্যুৎ, গ্যাস, বাতাস, সৌর বিদ্যুৎ, তেল ও বায়োগ্যাস অন্যতম। এর মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎই দীর্ঘমেয়াদি। বিশ্বে বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৭ থেকে ২৪ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে পরমাণু শক্তি থেকে। ফ্রান্স ৭৯ শতাংশ বিদ্যুৎ পাচ্ছে পরমাণু শক্তি থেকে, বেলজিয়াম পাচ্ছে ৫৮, জাপান ৫৫, সুইডেন ৪৪, কোরিয়া ৪০ ও যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ। চীন এ খাত থেকে উৎপাদন করছে ৯ হাজার মেগাওয়াট, ভারত ৪ হাজার ২০ মেগাওয়াট ও পাকিস্তান ৪২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যদিও ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করছে, কিন্তু তারাও তাদের পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এবং পাকিস্তান চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মনে রাখতে হবে, কয়লা পোড়ানোর ফলে কার্বন নির্গমন হয় অতি মাত্রায়। ভারতে কয়লা থেকে কার্বন নির্গত হয় বছরে ২৭৯.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পাকিস্তানে হয় ২৯.৬১ এবং বাংলাদেশে ৮.৮ মিলিয়ন টন। কয়লা, বায়োগ্যাস ও তেল_এ পদ্ধতির ওপর কিছু সময়ের জন্য নির্ভর করা যেতে পারে; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে এর স্বল্পতা, জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং কৃষিতে কুপ্রভাব পড়তে পারে। কয়লা বা গ্যাস পরিবেশ দূষণ থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন_ভূপৃষ্ঠের তাপ বৃদ্ধির ফলে পরিবেশগত পরিবর্তন দেখা দেয়। ফলে বনাঞ্চল ও মৎস্যসম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ব্যাপক খনিজ আহরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে। যত বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হবে, তত বেশি কার্বন ডাই-অঙ্াইড নির্গত হয়ে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। পরমাণু দুর্ঘটনা নিয়ে আমি আমার আগের এক নিবন্ধে লিখেছিলাম (কালের কণ্ঠে প্রকাশিত)। জাপানে যে দুর্ঘটনা সম্প্রতি ঘটে গেল, তা কিন্তু ভয়াবহ ভূমিকম্পের জন্য। আমাদের এটাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, আমাদের দেশ কতটুকু এবং কী পরিমাণ ভূমিকম্পের আওতায় আছে। আমাদের দেশের ইতিহাসে ৯৩ বছর আগে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে সর্বশেষ বড় মাপের অর্থাৎ ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়েছিল। ১২৫ বছর আগে মধুপুরে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল; তাও ৭ মাত্রার। গত ৯২ বছরে বাংলাদেশে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোনো নজির নেই। জাপানের মতো ভূমিকম্প আমাদের দেশে হওয়ার কোনো আশঙ্কা আছে বলে মনে হয় না। তাই ভীতি সঞ্চার করা ঠিক নয়। তবে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। এ বছর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা আছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। ২০১২ সালের শেষ দিকে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্র্মাণকাজ শুরু হবে। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া অবকাঠামোগত নির্মাণ, বিতরণ ও সঞ্চালনব্যবস্থা, জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দেবে। প্রথম দফায় দুটি প্লান্টের প্রতিটিতে ৫০০ করে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার (এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পরমাণু বিদ্যুতের প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও যখন এটা স্থায়ীভাবে উৎপাদন শুরু করতে থাকবে, তখন এর মূল্যে অন্যান্য বিকল্প পদ্ধতির চেয়ে অনেক কম খরচ হবে এবং স্থান, দেশভেদে ও পরিমাপের ওপর নির্ভর করে এর মূল্যে কমবেশি হবে)। জাপানে যেখানে কয়লায় খরচ হয় প্রতি ইউনিটে চার ডলার ৯৫ সেন্ট এবং গ্যাসে পাঁচ ডলার ২১ সেন্ট, সেখানে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিটে চার ডলার ৮০ সেন্ট। কোরিয়ায় কয়লায় দুই ডলার ১৬ সেন্ট, গ্যাসে চার ডলার ৬৫ সেন্ট এবং পরমাণু বিদ্যুতে প্রতি ইউনিটে দুই ডলার ৩৪ সেন্ট খরচ হয়। ফ্রান্সে পরমাণুতে খরচ হয় দুই ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় তিন ডলার ৩৩ সেন্ট এবং গ্যাসে তিন ডলার ৯২ সেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ইউনিটে খরচ হয় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে এক ডলার ৯২ সেন্ট, গ্যাসে দুই ডলার ৬৮ সেন্ট এবং তেলে তিন ডলার ৭৭ সেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে কয়লায় খরচ হয় এক ডলার ৮৮ সেন্ট। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর জন ম্যাকার্থি গবেষণা করে মতামত দিয়েছেন, কয়লা, তেল ও গ্যাস_এই বিকল্প পদ্ধতিগুলোর ওপর কিছু সময়ের জন্য নির্ভর করা যেতে পারে; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সম্ভব নয়। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য অপসারণের ব্যাপারে সহায়তা দেবে রাশিয়া।
আমরা জাপানে ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের দিকে ফিরে তাকাই। সেখানে কী ঘটেছিল? রি-অ্যাক্টরের ভেতরের তেজস্ক্রিয় ফুয়েল রডগুলো পানির ভেতর ডোবানো থাকে, যা স্বাভাবিকভাবে ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করে। কিন্তু কোনো কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেলে ফুয়েল রডগুলোর তাপমাত্রা ১২০০ ডিগ্রিতে পেঁৗছতে পারে, যা ফুয়েল রডগুলোকে গলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। একে মেল্টডাউন বলা হয়। ১১ মার্চ ভূমিকম্পের পরপরই মেল্টডাউন রোধের প্রথম ক্রিয়া চালু হয়ে যায়। রি-অ্যাক্টরের ভেতর বিক্রিয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিতে নিউট্রন শোষক পদার্থের তৈরি কন্ট্রোল রড প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে রি-অ্যাক্টরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ থেমে যায়। কিন্তু ফুয়েল রডগুলো তখনো গরম হয়েই ছিল। সেগুলো ঠাণ্ডা করার জন্য রি-অ্যাক্টরের ভেতর পানির সচল প্রবাহ কাজ করার কথা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভূকম্পনের পরপরই বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ প্রক্রিয়া কাজ করেনি। এরপর মেল্টডাউন রোধের দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি চালু হয়। এ সময় ডিজেল জেনারেটরের সাহায্যে উত্তপ্ত ফুয়েল রডগুলোর ওপর পানির স্প্রে করা হয়। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর ডিজেল জেনারেটর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় প্রায় ১০ মিটার উঁচু সুনামির ঢেউ পাওয়ার প্লান্টে আঘাত হানে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ কারণেই জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তৃতীয় আরেকটি নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। এ ব্যবস্থায় বাষ্পকে তরলে পরিণত করে রি-অ্যাক্টরের ভেতর প্রবাহিত করানো হয়। কিন্তু সেই সময় রি-অ্যাক্টরের পানির পরিমাণ এত নিচে নেমে যায় যে ওই প্রক্রিয়াটিও কাজ করেনি। ফলে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এভাবেই কেন্দ্রে একের পর এক তিনটি নিরাপত্তাব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রফেসর আকিদো ওমোতো, যিনি এই রি-অ্যাক্টরের ডিজাইনের সঙ্গে জড়িত, মনে করেন, কোনোভাবে রি-অ্যাক্টরের ভেতরের তরল রি-অ্যাক্টর থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ে এবং ভূমিকম্প ও সুনামির ক্ষয়ক্ষতি রোধে নেওয়া সব ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তখন রি-অ্যাক্টরের ভেতর সাগরের পানি প্রবেশ করানো হয়, যা রি-অ্যাক্টরটি নষ্ট করে ফেলে। এর ফলে রি-অ্যাক্টরের ভেতরকার পানি বাষ্প হয়ে বাতাসে হাইড্রোজেন ও অঙ্েিজনের সঙ্গে মিলে বিস্ফোরক তৈরি করে। এর পরই ঘটে বিস্ফোরণ, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয়া। এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি রেখেই নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি করা হবে পারমাণবিক চুলি্ল_জানিয়েছেন পরমাণুবিজ্ঞানীরা।
জাপানে ভূমিকম্পের ফলে যে দুর্ঘটনা পরমাণু চুলি্লতে ঘটল, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়া তার প্রযুক্তি দিয়ে পরমাণু চুলি্ল তৈরি করবে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। জাপানের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প নষ্ট হয়ে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বজুড়ে পরমাণু বিদ্যুৎ বন্ধের যে দাবি উঠেছে, সেই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান পরিবেশ উপদেষ্টা প্রফেসর রস গ্লার্নট বলেন, 'গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় পরমাণু বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।' তিনি আরো বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধে পরমাণু বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাপানে দুর্ঘটনা সত্ত্বেও বিশ্বের ভবিষ্যৎ জ্বালানি ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তির এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। পরমাণু বিদ্যুৎ ছাড়া পরিবেশগত পরিবর্তন মোকাবিলা করা খুবই অর্থবহুল ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প নেই।' বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। বিদ্যুৎ চাহিদার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে পরমাণু বিদ্যুতের বিকল্প নেই।

লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.