বাঘা তেঁতুল-বাজে দৃষ্টান্ত! by সৈয়দ আবুল মকসুদ

আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় কিছু কঠোর বিধিবিধান ও আইনকানুনের দ্বারা। গুপ্ত রাজবংশের সময় অথবা পাল ও সেন রাজাদের সময় তা ছিল না। মোগল বাদশা হমায়ুন বা আকবরের সময় ফাইলপত্রের পরিমাণ ছিল খুবই কম। মৌখিক নির্দেশে অনেক কাজ হতো।

খুব বেশি জরুরি ও বড় ব্যাপারে ফারসি ভাষায় ফরমান জারি হতো। রাজ্যে এখনকার মতো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা সংস্থাপন বিভাগ ছিল না। পার্লামেন্ট তো ছিলই না। শাসকের গুটিকয় সভাসদকে দিয়েই সংসদের কাজ চলে যেত। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে সাংবিধানিক বিধিবিধান কড়াকড়িভাবে না মেনে উপায় নেই।
এক নেতার দেশে ফেরার খবর পত্রপত্রিকায় কয়েক দিন ধরে ফলাও করে আসছে। খবরে বলা হয়েছে: ‘দীর্ঘ সাত মাসেরও বেশি বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরছেন আলোচিত পদত্যাগী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ এমপি।’ তাঁর এলাকার আওয়ামী লীগের সভাপতি সমকালকে জানান, ‘আমরা সোহেল তাজকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর যাব। তার আসার খবরে আমরা আনন্দিত। এই কারণে এলাকাবাসীর ঘরে ঘরে আনন্দের বাতাস বইছে।’ তিনি আরও বলেছেন, নেতা দেশে না থাকলেও ‘তার সঙ্গে টেলিফোনে সব বিষয়ে সমন্বয় হতো।’ কাপাসিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘সোহেল তাজ বাংলাদেশ ও কাপাসিয়াকে ভুলে থাকতে পারেন না।’ থানা ছাত্রলীগের নেতা বলেছেন, ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে এলাকাবাসী ওইদিন বিমানবন্দরে নেতাকে স্বাগত জানাতে যাবে। সোহেল তাজ ছাড়া তাঁরা অভিভাবকহীন ছিলেন। তাঁর আসার খবরে তিনি এত খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না।’ [যায়যায়দিন]
দৈনিক ডেসটিনি লিখেছে, ‘দীর্ঘ সাত মাস যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকার পর’ তিনি বুধবার সকালে বাংলার মাটিতে পদার্পণ করবেন এবং ‘তাকে বরণ করতে গাজীপুরবাসী বিশেষ করে কাপাসিয়া থানা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে ব্যাপক প্রস্তুতি।’
শব্দ প্রয়োগে আমাদের পত্রপত্রিকা খুবই যথাযথ। বস্তুনিষ্ঠতা তো রয়েছেই। হঠাত্-হঠাত্ খবরের কাগজ পড়ে গ্রামবাংলার এমন কোনো পাঠক জানতে পারল প্রিয়জনহীন বিদেশ-বিভুঁইয়ে সাতটি মাস ‘স্বেচ্ছানির্বাসনে’ থেকে দেশমাতৃকার ডাকে নেতা ফিরে আসছেন। সুতরাং তাঁকে ‘বরণ করতে’ বিমানবন্দরে সংবর্ধনার আয়োজন তো হতেই পারে। তা ছাড়া ভৌগোলিক সুবিধা এটুকু যে গাজীপুর আর জিয়া বিমানবন্দর কাছাকাছি। সুতরাং যানবাহনের বিঘ্ন ঘটিয়ে বিমানবন্দরে ফুল নিয়ে উপস্থিত হওয়া কোনো সমস্যা নয়।
কৃতী ব্যক্তির ওপর পুষ্পবৃষ্টি প্রাচীন ভারতে হতো। কেউ নতুন কোনো দেশ জয় করে ফিরে এলে মানুষ জয়ধ্বনি দিত। রাজধানীতে বাজত কাড়ানাকাড়া। আজ বিদেশ থেকে কেউ ফিরে এলেই গুণমুগ্ধরা বলে: বাজাও ঝাঁঝর বাদ্যি। কোনো নেতা ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, কোপেনহেগেন, লন্ডন বা দিল্লি থেকে দেশে ফিরে এলে বিমানবন্দর এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা থেকে বগুড়া বা বরিশাল গেলেও নেতাজিদের খালি আকাশের নিচ দিয়ে নয়, অসংখ্য তোরণের তলা দিয়ে যেতে হয়।
আজ রাজনীতিতে কোথাও জাঁকজমকের কমতি নেই। এ মাসের শুরুতে পল্টনে পল্লিবন্ধুর জাতীয় পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে মঞ্চের কাছে দেখা গেল কয়েকটি প্রকাণ্ড হাতি ও তেজি ঘোড়া। হাতি-ঘোড়া শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। সম্মেলন উপলক্ষে ‘সর্বকালের’ ইত্যাদি ইত্যাদি ‘পল্লিবন্ধু’র নামে ঢাকা থেকে নয়ারহাট পর্যন্ত অসংখ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল দামি কাপড় দিয়ে। যানজটের দেশ। তোরণের খাম্বা পুঁততে খোঁড়া হয়েছিল পিচঢালা রাস্তা। কার বাবার সাধ্য বাধা দেয়। অথচ মনে আছে, একাত্তরের শেষ হপ্তায় যেদিন প্রবাসী সরকারের নেতারা ঢাকায় এলেন সেদিন তাঁরা কোনো সংবর্ধনা নেননি। সংবর্ধনা তাঁদেরই প্রাপ্য ছিল।
যা হোক, কোপেনহেগেন থেকে দুনিয়ার জলবায়ুর দফারফা করে আসুন আর স্বেচ্ছানির্বাসন থেকেই আসুন, কেউ সংবর্ধনা পেলে কোনো কলামলেখকের ঈর্ষার কিছু নেই। যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছি, আধুনিক রাষ্ট্র চলে আইনকানুনে, মৌখিক নির্দেশে নয় গুপ্ত বা পালযুগের মতো। সোহেল তাজ সম্পর্কে আর একটি প্রতিবেদন এ রকম: ‘প্রায় আট মাস আগে পদত্যাগ করার পরও সরকার নিয়ম রক্ষা না করায় প্রশ্ন উঠেছে, কাগজে-কলমে তানজিম আহমদ সোহেল তাজ এখনো প্রতিমন্ত্রী আছেন কি না। আজ অবধি প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে পদত্যাগের বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কোনো গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে তাঁর প্রতিমন্ত্রীর পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়নি। এ অবস্থায় তার দেশে ফিরে আসার খবরে সরকারের ভেতরে নতুন করে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, সোহেল তাজ দেশে ফিরে পদত্যাগ করেননি দাবি করলে সরকার তৃতীয়বারের মতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে। সোহেল তাজ গত বছর প্রথম দফায় ১ জুন ও পরের দফায় ৩১ মে পদত্যাগ করেন বলে দাবি করেন। অথচ তিনি ৮ জুন সর্বশেষ মন্ত্রিসভা বৈঠকে যোগ দেন। ১ জুন কিংবা ৩১ মে পদত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান অনুযায়ী যদি তাঁর পদ শূন্য বলে বিবেচিত হয়, তা হলে ৮ জুন সোহেল তাজের মন্ত্রিসভা বৈঠকে অংশগ্রহণ ছিল অবৈধ।’ [কালের কণ্ঠ]
জননেতার পদত্যাগ সম্পর্কে কোনো নির্দেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এসেছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, ‘মনে হয় কোনো নির্দেশনা আসেনি। তিনি এখনো সরকারের প্রতিমন্ত্রী কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ পদত্যাগ করলে তো আর প্রতিমন্ত্রী থাকেন না।’ চমত্কার জবাব।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সব সাংসদই যদি আট-দশ মাসের জন্য ‘স্বেচ্ছানির্বাসনে’ যান তা হলে ভালোই দিনবদল হবে! বিরোধী দল সংসদে না গিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে দোষটা করছে কী? বাংলাদেশেই নিন্দনীয় কাজ করে তিরস্কৃত না হয়ে সর্বোচ্চ প্রচার পাওয়া যায়। প্রিয়জনের প্রতি প্রীতিবশত কারও ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করতে করতেই আজ সোনার বাংলার এই দশা। খাতিরের লোকের খামখেয়ালি ও সরকারের অস্বচ্ছতাকে আমরা সহজভাবে গ্রহণ করি। পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রীর এই ঘটনা একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.