লাতিন আমেরিকা-চিলির রাজনীতির মোড় পরিবর্তন by জাস্টিন ভগলার

১৭ জানুয়ারি চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে ধনকুবের সেবাসতিয়ান পিনেরা ৫১ দশমিক ছয় শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। তাঁর এ বিজয় মধ্যবামপন্থী জোট কনসারটেশিয়নকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই জোট প্রথম দফার নির্বাচনে ভালো ফল করেনি।


তবু জোটের সমর্থকদের কম মানুষই ভেবেছিল, তাদের প্রার্থী এডুয়ার্ডো ফ্রেই সত্যি সত্যি হেরে যাবেন (তিনি পেয়েছেন ৪৮ দশমিক তিন শতাংশ)। ফ্রেই এক কঠোর ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট; ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চিলির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।
সেবাসতিয়ান পিনেরার যে হাজার হাজার সমর্থক উল্লাস করতে সান্তিয়াগোর রাস্তায় নেমে এসেছিল, তারাও এই ফলাফলে অভিভূত। পিনেরার সমর্থকেরা তাঁকে প্রশংসাসুলভ বাক্যবাণে ভাসাচ্ছিল। বিজয়ী ও বিজিত উভয়ের জন্য চিলির রাজনীতিতে তখন এক ঐতিহাসিক পালাবাদল ঘটছিল। ১৯৫৮ সালের পর চিলিতে প্রথম রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন পিনেরা। আর প্রথম ডানপন্থী হিসেবে তিনি ৫০ শতাংশের বেশি জনসমর্থন লাভ করে ক্ষমতাসীন হলেন। প্রেসিডেন্ট মিশেল বেচেলেট চিলিতে প্রচণ্ড জনপ্রিয়। তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে—পিনেরার বিজয়ের আগ পর্যন্ত এটা অভাবনীয় ছিল। ১৯৮৮ সালে অগাস্তো পিনোশের শাসন বিষয়ে গণভোটে না ভোটের জয়লাভের পর এত দিন চিলির রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করেছে কনসারটেশিয়ন। দুই দশকজুড়ে তারা ছিল চিলির নীরব সংখ্যাগুরু। আর প্রতিপক্ষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হলেও রাজনৈতিকভাবে ছিল সংখ্যালঘু। ১৭ জানুয়ারি বিকেলে এডুয়ার্ডো ফ্রেই পরাজয় মেনে নিলে চিলির চিত্র পাল্টে যায়।
কেমন করে ডানপন্থীরা জয়ী হতে পারল আর কেমন করেই বা লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে সফল শাসকজোটের এমন পরিণতি ঘটল? পিনেরা ভালো রকমের প্রচারণা চালিয়েছেন এবং ভুল করেছেন কম। সারা দুনিয়ার জনপ্রিয়তাবাদী রক্ষণশীল নেতাদের মতো তিনিও মনোমুগ্ধকর সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—কঠোর হাতে অপরাধ দমন, লাখ লাখ চাকরির ব্যবস্থা করা, দর্শনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন—এসব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর দরিদ্র থেকে ধনী হওয়ার গল্প। তা ছাড়া তাঁর নয়া উদারবাদী রেনভেশিয়ন ন্যাশিয়নাল ও কট্টর রক্ষণশীল ইউনিয়ন ডেমোক্রেটিকা ইনডিপেনডিয়েন্টের মধ্যকার জোটের অন্তর্দ্বন্দ্ব আড়াল রাখতে পেরেছেন।
নিজেদের পরাজয়ের জন্য কনসারটেশিয়ন জোটের অনেকে দোষারোপ করবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মার্কো এনরিকেজ ওমিনামিকে। তিনি প্রথম দফায় ২০ শতাংশ ভোট পান। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের সময় উভয়পক্ষ ওমিনামির সমর্থকদের মন জয়ের আপ্রাণ চেষ্টা চালায়, তাঁর সমর্থন পাওয়ার আশায় তাঁর উপদেষ্টাদের কাছে ধরনা দিতে থাকে। নির্বাচনের একেবারে আগ পর্যন্ত ওমিনামি বলে গেছেন, পিনেরা ও ফ্রেইয়ের মধ্যে কোনো তফাত নেই। শেষমেশ তিনি ফ্রেইকে ভোট দেওয়ার ইঙ্গিত দেন।
কিন্তু ওমিনামির প্রসঙ্গটি শুধু মূল জায়গা থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়। কারণ মধ্যবামপন্থী জোটের অধিকাংশ সদস্য মনে করেন, ধার্মিক ও অনুজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের ফ্রেইকে প্রার্থী করাটা শুরু থেকেই ভুল ছিল। যে প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি প্রার্থী নির্বাচিত হন সেটাও ছিল কৌতুককর। ২০০৮ সালে কনসারটেশিয়নের তিনজন পরাক্রমশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর (রিকার্ডো লাগোস, হোসে মিগুয়েল ইনসুলজা ও ফ্রেই) মধ্যে শেষ পর্যন্ত ফ্রেই অন্য দুজনকে টপকে যান এবার ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটদের মধ্য থেকে প্রার্থী করার পালা থাকার কারণে। তা ছাড়া লাগোস ও ইনসুলজা বুঝতে পেরেছিলেন, জনসমর্থন ছাড়া মনোনয়ন আত্মঘাতী হতে পারে। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ওমিনামিসহ অনেককে বাদ দিয়ে প্রাথমিক নির্বাচন মঞ্চস্থ করা হয়। জনমতের প্রতি কোনো মনোযোগ দেওয়া হয়নি। চিলিবাসী দেখেছে, কনসারটেশিয়ন জোট কয়েকটি দলের স্বার্থ ভাগাভাগির নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। তারা এ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের উচ্ছিষ্ট ভাগ-বাটোয়ারার ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
২০০৬ সালে মিশেল ব্যাশেলেটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ছিল চিলির রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর আগের ও পরের চিলি এক থাকেনি। ফ্রেই আগের পর্বের মানুষ—এটি বুঝতে না পারা কনসারটেশিয়নের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। এবারের নির্বাচনের প্রার্থী দুর্বল ছিলেন। প্রচারণাও ছিল নিম্নমানের। জোটের ভেতর ছিল তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব। ফলে প্রতিপক্ষের দুর্বলতাই শেষ পর্যন্ত পিনেরার বিজয় নিশ্চিত করেছে; কনসারটেশিয়ন নিজেই নিজের বিনাশ ডেকে এনেছে।
পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ফ্রেই মধ্যবামপন্থীদের ঐক্য অব্যাহত রাখার এবং এ পরাজয়কে ‘সাময়িক পরাজয়’ হিসেবে গণ্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটার সম্ভাবনা কম। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট, র্যাডিকেল ও সোশ্যালিস্টদের জোট একসঙ্গে ছিল মূলত অগাস্তো পিনোশের বিরোধিতা ও তাদের ক্ষমতালিপ্সার কারণে। পিনোশে এখন মৃত আর ক্ষমতাও হাতছাড়া। ফ্রেইয়ের পরাজয়ের আগেই জোট ভেঙে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। নিজেদের মধ্যে ডান ও বাম অংশে উপদলীয় বিভক্তি দেখা দিচ্ছিল। জোটের নেতারা সংস্কার ও জীর্ণ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু যে ক্ষমতা তাদের জোটের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছিল, তা হাতছাড়া হওয়ায় পারস্পরিক দোষারোপ ও অন্যের ওপর দায় চাপানোর ফলে জোট ভেঙে পড়াও অসম্ভব নয়।
পিনেরার নির্বাচন নতুন আঙ্গিকে পিনোশেবাদ ফিরে আসার পথ করে দিয়েছে, এমন গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর এক উত্তেজিত সমর্থক পিনোশের আবক্ষমূর্তি দোলাচ্ছেন এমন ছবি তা আরও জোরালো করেছে। পিনেরার এক বৈরী ভ্রাতা পিনোশের স্বৈরাচারী শাসনের সময়ে মন্ত্রী ছিলেন; তাঁর বহু জোটগত মিত্র পিনোশের অনুসারী ছিলেন। তাঁদের সমর্থনের প্রতিদান দিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে। অবশ্য পিনেরা জানেন, অতীতের স্বৈরশাসকের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র দেশের বাইরে তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতি করবে, নিজের দেশেও বড় সমস্যা তৈরি করবে।
তা ছাড়া পিনোশের সময়ের অধিকাংশ বিশিষ্ট ব্যক্তি এখন মারা গেছেন বা অবসরে চলে গেছেন। অনেকে মনে করেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ডানপন্থীদের বিজয় দেশটিতে সংহত গণতন্ত্রে উত্তরণের মধ্যবর্তী সময়ের অবসানের ইঙ্গিত দেয়।
রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রে পিনেরার শাসনামলে দুটি বিষয় ঘটবে বলে ধারণা করা যায়। ব্যাশেলেটের আমলে যে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সূচনা হয়েছিল, তা থ্যাচারীয় ব্যক্তিত্ববাদী আঙ্গিকে ফিরে যাবে। বিজয়ীর ভাষণে পিনেরা ঘোষণা করতে পারতেন, তিনি সামাজিক নিরাপত্তার জাল সুরক্ষিত ও বিস্তৃত করবেন; কিন্তু তিনি যা বললেন তাতে তাঁর প্রকৃত ইচ্ছার আভাস পাওয়া যায়: ‘অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় আমি বলতে চাই, কোনো চিলিবাসী নিজের মেধা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজের অবস্থানের উন্নতি ঘটালে আমরা সবচেয়ে খুশি হব।’
দ্বিতীয় বিষয়টি চিলির সরকারি খাতের বিশৃঙ্খলা। প্রেসিডেন্টের হাতে মন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মচারী মিলিয়ে এক হাজার ৩০৬ জন নিয়োগের বিশেষ ক্ষমতা আছে। আর এসব নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি কয়েক শ বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী মনোনীত করেন। এর অর্থ হলো, কনসারটেশিয়নের যে কর্মীরা গত দুই দশক ধরে রাষ্ট্রযন্ত্র চালাচ্ছিলেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হবে। পিনেরা নিয়োজিত প্রশাসনে আনকোরা ব্যক্তিদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে আক্রান্ত হবে। কারণ রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট আর কয়েকটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে নিয়োগ দিতে হবে নির্বাচনের পুরস্কার হিসেবে। এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীল বামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য।
লাতিন আমেরিকার রাজনীতি ও কূটনীতিতে মিশেল ব্যাশেলেটের বিশাল অর্জনের কারণে চিলির এই উল্টো স্রোতে যাত্রার বিষয়টি বোঝা অনেকের পক্ষে কঠিন। নির্বাচনে জেতার জন্য ডানপন্থীদের বিশেষ কিছু করতে হয়নি; বরং কনসারটেশিয়নের আত্মতুষ্টিই তাদের জন্য কাল হয়েছে। এর ফলে চিলির ইতিহাসে এক নব-অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
ওপেন ডেমোক্রেসি থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জাস্টিন ভগলার: চিলিভিত্তিক সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.