মনের কোণে হীরে-মুক্তো-রাজনীতিতে হরতালের সরব প্রত্যাবর্তন by ড. সা'দত হুসাইন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে হরতাল অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। সভা, সেমিনার এবং গণমাধ্যমে এর অপকারী দিকগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপিত হচ্ছিল। সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত এবং বিশেষভাবে ব্যবসায়ী সমাজ হরতালের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে বেশ নমনীয়।


তাঁরা নিজেদের সুবিধা-অসুবিধা বিচার-বিবেচনা করে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেন। সাধারণত যে দল ক্ষমতায় থাকে তার নেতারা-সমর্থকরা হরতালের বিপক্ষে থাকেন। অন্যদিকে সরকারবিরোধীরা হরতালের পক্ষে বক্তব্য দেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্থানীয় ইস্যুতে সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরাও স্থানীয় পর্যায়ে হরতালকে পালন করে। ক্ষমতাসীন দল এ ক্ষেত্রে হরতাল বানচাল করতে চেষ্টা করে না, এমনকি হরতালের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য-বিবৃতিও রাখে না। এরূপ ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের উদার-উদাসীনতা প্রদর্শন করে। মোট কথা, স্থান-কাল-পাত্র ও স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনীতিবিদরা হরতাল সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য এবং কৌশল নির্ধারণ করেন।
সমাজের অনেক প্রখ্যাত এবং জ্ঞানী হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তি প্রায়ই বলে থাকেন, প্রতিবাদের অস্ত্র বা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে হরতাল ভোঁতা এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এখন বিকল্প কোনো সৃজনশীল হাতিয়ার প্রয়োগ করা প্রয়োজন, যাতে কোনো জনগোষ্ঠীর কষ্ট না হয় এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ব্যাহত না হয় বা রাস্তাঘাটে কোনো ধরনের সমস্যার সৃষ্টি না হয়। উত্তম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আজ পর্যন্ত কোনো জ্ঞানী বা মেধাবী ব্যক্তি এরূপ কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ার বা বিকল্প কৌশল নির্মাণ করতে পারেননি। বিগত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন বিরোধী দল (মহাজোট) কিছু বিকল্প কৌশল নিয়ে এগোতে চেষ্টা করেছিল। তার একটি ছিল নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত রোডমার্চ বা লংমার্চ। শান্তিপূর্ণভাবে এ আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিব একে 'গুড ইভিনিং ওয়াক' হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন। এই মার্চ ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোনো উদ্বেগ, আতঙ্ক, প্রভাব কিংবা অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি। নিশ্চিন্তে, নিরাপদে, ভাবলেশহীনভাবে তারা পরের দিন নিজেদের কাজকর্ম করেছে। বিরোধী জোটের আগের দিনের নব-উদ্ভাবিত কর্মসূচিকে তারা গায়েই মাখেনি। অবশেষে বিরোধী জোট যে শুধু হরতালের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল তা-ই নয়, হরতালকে শাণিত করার জন্য তার সঙ্গে অবরোধ কর্মসূচি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন শাসক জোট (বর্তমান বিরোধী জোট) এতে কাবু হয়ে পড়েছিল।
বিভিন্ন নামে অভিহিত হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে এতদঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে হরতাল প্রতিষ্ঠানটি চালু রয়েছে। আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞায় হরতাল বলতে বোঝায় সাধারণ ধর্মঘট। এর অর্থ হচ্ছে ঘোষণা দিয়ে সব ধরনের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। কলকারখানা-দোকানপাট বন্ধ থাকবে, রাস্তায় যানবাহন চলবে না, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হবে না, পরীক্ষা স্থগিত থাকবে, নির্মাণ এবং উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ থাকবে ইত্যাদি। বর্তমানে বাস্তব ক্ষেত্রে সাধারণ মানের হরতালের সময় যন্ত্রচালিত যানবাহন রাস্তায় চলে না, এর বদলে বড় রাস্তায় নিষিদ্ধ মানবশক্তি চালিত রিকশা, ভ্যানগাড়ি ও সাইকেল প্রচুর সংখ্যায় চলে। আজকাল সিএনজি, টেম্পো ও ইজি-বাইককেও হরতালকালে চলাচল করতে দেখা যায়। ট্রেন চলাচল অব্যাহত থাকে, লঞ্চও চলে। কাঁচাবাজার খোলা থাকে, অনেক কল-কারখানা খোলা থাকে, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকাজও চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট বন্ধ থাকে। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে যেমন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শেষ ভাগে বা ইয়াজউদ্দিন সরকারের শেষ দিকে রিকশা, ভ্যান চলাচলেও বাধা দেওয়া হয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সব কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। শাসক দলের কার্যকারিতা অনেকটা লোপ পায়। প্রকৃত ক্ষমতার বিরাট অংশ আন্দোলনকারী বিরোধী শক্তির কাছে চলে যায়, যার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে একাত্তর সালের মার্চ মাসের অবস্থা।
হরতাল যে সব সময় বড় কোনো আন্দোলনের অংশ হিসেবে করা হয়, তা নয়। সরকার গঠনের বছর খানেক বা দুই বছরের মধ্যে সংসদে ক্ষীণ বল বিরোধী দল তাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে শুধু 'জানান দেওয়ার' জন্য পূর্ণ দিবস কিংবা অর্ধ দিবস হরতাল পালন করে। এটি হয় সাধারণ মানের ঢিলেঢালা হরতাল। যন্ত্রচালিত যানবাহন, কিছু এলাকার দোকানপাট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে না। হরতাল আহ্বানকারী বিরোধী দলও হরতাল কার্যকর করার ব্যাপারে অর্থবহ পদক্ষেপ নেয় না। বড় রকমের সংঘর্ষ বা ঘটনা ছাড়াই হরতালের দিনটি অতিবাহিত হয়। তবে বিরোধী দলের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়। লোকজন তাদের 'হিসাবযোগ্য' শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। 'নন-গভর্নিং এলিট' হিসেবে সমাজে তারা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় হিসেবে এরূপ হরতালকে তারা ব্যবহার করে মাত্র।
হরতাল আহ্বান করার সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যেকোনো দল বা গোষ্ঠী ইচ্ছে করলেই হরতাল আহ্বান বা কার্যকর করতে পারে না। জনগণ এ ধরনের আহ্বানকে পাত্তাই দেয় না, অর্থবহ হরতাল আহ্বানের জন্য শত্তিশালী রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনের প্রয়োজন হয়। অতীতে ছোট ছোট দল হরতাল আহ্বান করে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। মাঠপর্যায়ে হরতাল কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মীবাহিনী তাদের ছিল না। ফলত, রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া পুরোদমে চলেছে, দোকানপাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সবই খোলা ছিল। এক কথায় হরতাল বাস্তবায়নে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ছোট দল বা গোষ্ঠী আজকাল হরতাল আহ্বান করে না বললেই চলে।
হরতাল যেহেতু আবার সরবে ফিরে এসেছে, তাই এর অর্থনৈতিক সংশ্লেষ আলোচনার দাবি রাখে। হরতালে দেশ অর্থনৈতিকভাবে কী রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল যুগ যুগ ধরে এ ব্যাপারে পরস্পর বিপরীতধর্মী বক্তব্য দিয়ে আসছে। সভা-সেমিনারে সরকারের প্রতিনিধি বলেন, হরতালে অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি হয়। আবার হরতালের রাতে প্রেস রিলিজে সরকার ঘোষণা দিয়ে থাকে, হরতালের সময় কল-কারখানায় কাজ চলেছে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে, অফিস-আদালতে উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল; ট্রেন, প্লেন ও বাস অন্যান্য দিনের মতোই চলেছে; সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। আসলে এ ব্যাপারে এখনো ভাবাবেগবর্জিত নিরপেক্ষ কোনো সমীক্ষা চালানো হয়নি। লেখকের ধারণা, আগে ঘোষণা দিয়ে এক দিনের হরতাল পালন করা হলে 'ইকোনমিক এজেন্ট'রা তাদের কর্মপরিকল্পনা এমনভাবে সমন্বয় করে নেয় যে সামগ্রিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে লাগাতার হরতাল বিশেষ করে পূর্বঘোষণা ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত করে। এ ক্ষেত্রে 'ইকোনমিক এজেন্ট'রা তাদের কর্মপরিকল্পনাকে সমন্বয় করার সুযোগ পায় না। অতএব ক্ষতি অনিবার্য।
দীর্ঘর্দিন পর সরবে এবং সগর্বে হরতাল ফিরে আসায় ধরে নেওয়া যায় যে যত দিন দেশে রাজনীতি থাকবে, তত দিন হরতালও থাকবে; যেকোনো অজুহাতেই হোক না কেন। হরতালের বিকল্প শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। এর নিকটতম বিকল্প হচ্ছে 'অবরোধ', যা হরতালের চেয়েও হিংসাত্মক ও ধবংসাত্মক। হরতালের কার্যকর বিকল্প হতে পারে- প্রথমে হরতালের কারণ নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা। অতঃপর এ কারণ দূর করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা সৃষ্টি করা।
হরতাল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হলেও এটি একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান নয়। তবে এর কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। হরতালকে প্রতিহত করতে গেলে এর তীব্রতা আরো বাড়ে।
নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি হয়। যখন কোনো রাজনৈতিক দল, স্থানীয় জনগণ বা একটি গোষ্ঠী বিশেষ হরতাল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, তখন বুঝতে হবে যেকোনো কারণেই হোক না কেন পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। একমাত্র আন্তরিক আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার মনোভাব, সহনশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌশলী পদক্ষেপের মাধ্যমেই এ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে।

লেখক : সাবেক সচিব ও পিএসসির
সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.