'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই' by সুভাষ সাহা

তাদের কারবার স্বর্গ-নরকের ভেদ নিয়ে। কোন কাজের কী ফজিলত সেটাও ব্যাখ্যার দায়িত্ব তারা নিজগুণেই ধারণ করেন। কী করলে ঈশ্বরের দিদার লাভ করা যায় আর কী কাজের কারণে বান্দার ওপর ঈশ্বর রুষ্ট হতে পারেন তা নির্ণয়ে তাদের এখতিয়ারও মহাশক্তির প্রতি আনত মর্ত্যের মানব মেনে নেয় নিদ্বর্িধায়।


এই ধর্মীয় বিশিষ্টদের একটি অংশ যখন মানুষের ঈশ্বরে আস্থা ও প্রেমকে পুঁজি করে মানুষকে সন্ত্রাসবাদের পথে টেনে নিতে চেষ্টা করেন, তখনি বাধে গোল। বিভিন্ন মাদ্রাসা, আখড়া-মঠ, গির্জা, স্বর্ণমন্দির তখন হয়ে ওঠে জঙ্গি তৈরির কারখানা। হিন্দু জঙ্গি, মুসলিম জঙ্গি, খ্রিস্টান জঙ্গি বা শিখ জঙ্গি এদের মধ্যে ভেদরেখা মুছে গিয়ে তখন লোকালয়ের শান্তি বিনষ্টকারী বিশাল বপু শ্বাপদের কার্টুন মানুষের ভয়ের জগতে বাসা বাঁধে। তারা ধর্মের নামে তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সম্প্রদায়ের নামে অতিক্ষুদ্র টোটেমসুলভ স্বার্থ হাসিলে মত্ত হয়। তখন তাদের মধ্যে সত্যসন্ধানী মানুষের শাশ্বত রূপ আর লেশমাত্রও থাকে না। আর তখন আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে অগুণিত মানুষ হতাহত করার মধ্যে রোজ কিয়ামতের তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা চলে। এই ধর্মীয় উগ্রবাদের ঝাপটা শেষ পর্যন্ত লোকালয়েও এসে লাগে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তরুণদের মধ্যে এ ধরনের জঙ্গিবাদী চিন্তা-চেতনা শিকড় গাড়ে। তখন পাহাড় বা গভীর অরণ্যের আস্তানার পরিবর্তে আমাদের শহর-গ্রামের এ-বাড়ি এবং ও-বাড়ির তরুণদের মধ্যে একই সাম্প্রদায়িক ভেদজ্ঞান পুষ্ট হয়ে সর্বনাশা আকার নেয়। এভাবেই একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক গ্রুপ সম্প্রতি অভিনব, তবে উপমহাদেশের চিরায়ত সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির ধারায় দক্ষিণ ভারতের বনেদি শহর হায়দরাবাদে এ মাসের প্রথম দিকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলিম জঙ্গিরা শহরের মদনাপীট মন্দিরে গরুর পা রেখে ও সবুজ রঙ মেখে দিয়ে মন্দিরকে অপবিত্র করেছে_ তা প্রচার করে হিন্দুদের মুসমানদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে এবং এর ফলে শহরে দাঙ্গা বেধে যায়। শেষ পর্যন্ত পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে পড়ল আসল ঘটনা। এই অপকর্মটি কোনো মুসলমান জঙ্গি গ্রুপ করেনি_ এটা যে চারজন মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু যুবকের সেটা প্রকাশ পেল। কিন্তু ততক্ষণে সামাজিক সম্প্রীতির বাতাবরণ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হয়তো অনেক সময় লাগবে ওই এলাকার দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও সহমর্মিতার আবহ পুনরায় গড়ে তুলতে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের স্মারক সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কীভাবে দু'দেশের মধ্যে স্পর্শকাতর সম্পর্কে গরল ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল তাতো ভারত সরকারই স্বীকার করেছে। অথচ ভারত প্রথমে এ জন্য পাকিস্তানের নটোরিয়াস গোয়েন্দা সংস্থা-আইএসআইর সমর্থনপুষ্ট জঙ্গি গ্রুপগুলোকে দায়ী করেছিল। এভাবেই মোল্লা-পুরোহিতদের কেউ কেউ মানুষকে বেহেশতের পরকালিক দরজা না দেখিয়ে লোকালয়কেই মূর্তিমান দোজখে পরিণত করার সর্বনাশা কাণ্ডে লিপ্ত হন দেশ থেকে দেশান্তরে।
আমাদের এখানকার সম্প্রতি মঞ্চায়িত দুটি সাম্প্রদায়িক নাটকও এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মসজিদের একটি অংশ হিন্দুুরা ভেঙে দিয়েছে এই ধুয়া তোলে হিন্দু মন্দির, দোকানপাট জ্বালিয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছিল। পরে তদন্তে বেরিয়ে এলো সত্য। একজন মুসলমান মিস্ত্রিকে দিয়ে মসজিদের একটি অংশ ভেঙে তার দায়ভার হিন্দু মিছিলকারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যারা এই ষড়যন্ত্রটি করেন তারা সবাই মুসলমান। তারা কি সবাই জঙ্গি! নিশ্চয়ই না। তবে জঙ্গিবাদ তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে বৈরী ধারণা সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। সাতক্ষীরার ঘটনাটির সঙ্গে একটি বিশেষ ইসলামী-ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টার মধ্যে একটা চমৎকার সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এহেন অপকর্মের হোতাদের লেবাস ও ধর্মীয় পরিচিতি যাই হোক না কেন তারা যেন 'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই'।
 

No comments

Powered by Blogger.