সুন্দরবন-বন রক্ষায় পর্যটনব্যবস্থা বদলে দিতে হবে by খসরু চৌধুরী

১৯৯৫ সাল থেকে সুন্দরবনে বেসরকারি উদ্যোগে নিয়মিত প্যাকেজ ট্যুর শুরু হয়েছে। দিনে দিনে আয়োজক কোম্পানি বেড়েছে, পর্যটক বেড়েছে, জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে, পর্যটন সেবার মানও বেড়েছে। বেড়েছে সরকারি রাজস্ব। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলোর জঙ্গলে ছবি তোলা।
এগুলোর সঙ্গে দেশি কিছু প্রতিষ্ঠানও যোগ দিয়েছে।
প্যাকেজ ট্যুরের প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও শীত মৌসুমে অনেক বেসরকারি লঞ্চ কোম্পানি সুন্দরবনে ভ্রমণ আয়োজন করছে। করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে শীত মৌসুমে প্রতিদিন কয়েক শ দর্শনার্থী হাজির হন। সব মিলিয়ে বন বিভাগ বন ভ্রমণ থেকে যথেষ্ট আয় পেয়ে থাকে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রচুর রাজস্ব পাওয়া সত্ত্বেও এত বছরে বন বিভাগ ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নয়নই করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। বন বিভাগ শুধু রাজস্বসাপেক্ষে দুজন বনরক্ষী জাহাজপ্রতি দিয়ে থাকে। ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা এখানেই শেষ।
বেসরকারি পেশাদার প্যাকেজ ট্যুর প্রতিষ্ঠানগুলো সারা বছরই কিছু না কিছু ভ্রমণ আয়োজন করে থাকে। এদের জাহাজগুলো নির্মিত হয়েছে পর্যটকদের প্রয়োজন মেটানোর কথা চিন্তা করে। এদের জাহাজগুলোয় পর্যটকদের সাহায্যার্থে প্রশিক্ষিত গাইড রয়েছে। তাঁরা সুন্দরবনের প্রকৃতি, গাছপালা ও পশুপাখি চেনান এবং বনে পালনীয় বিষয়গুলো পর্যটকদের অবহিত করেন। এসব লঞ্চের সারেংও দীর্ঘদিন বনে চলাচল করে আবহাওয়া বুঝতে পারেন, নদীপথের খাঁড়ি চেনেন। ফলে তাঁরা বাধাবিঘ্ন ছাড়াই জলপথে চলতে পারেন। এসব লঞ্চে পর্যটকদের ওঠা-নামার জন্য ডিঙি নৌকা থাকে। পর্যটকেরাও নিঃশব্দে খালে নৌকা চালিয়ে পাখি ও জীবজন্তু দেখতে পারেন। এসব জাহাজে বনরক্ষীদের আবাসনের ব্যবস্থাসহ পর্যটক বহন করা হয় সীমিতসংখ্যক।
অন্যদিকে মৌসুমে লঞ্চ মালিকদের আয়োজনে অথবা ভাড়া করা লঞ্চে যাত্রী নেওয়া হয় ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ। পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য গাইড হিসেবে কেউ থাকেন না। সারেংদের অধিকাংশই বনের জলপথের খাঁড়ি বুঝতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা চড়ায় লঞ্চ আটকে দিয়ে যাত্রীদের জীবন বিপদাপন্ন করে তোলেন। একেক জাহাজে তোলা দু-তিন শ যাত্রী সামলানো মাত্র দুজন বনপ্রহরীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক সময় বনপ্রহরীই নেওয়া হয় না। মাত্র কয়েকজনের রাজস্ব দেওয়া হয়। অন্যদের রাজস্বের বদলে কিছু টাকা বন অফিসের লোকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এসব জাহাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাত্রীদের নামানোর জন্য ডিঙি নৌকা নেওয়া হয় না। যাত্রীদের বিনোদনের জন্য লাউড স্পিকারে গান বাজানো হয়। এরা যাত্রীদের কটকা, কবিখালী অথবা হিরন পয়েন্টে নিয়ে ঘণ্টাদুয়েকের জন্য যাত্রীদের ইচ্ছেমতো হাঁটার ব্যবস্থা করে। জাহাজগুলোয় স্যানিটেশনের ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। যাত্রীরা ঠিকমতো খাবারও পান না। প্রাথমিক চিকিত্সার ব্যবস্থাও অনুপস্থিত। যাত্রীরা বন সম্পর্কে কোনো ধারণাই পান না। ফলে এসব জাহাজে যাঁরা একবার উঠেছেন, সুন্দরবন সম্পর্কে তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে আর কখনো সুন্দরবনে যাওয়ার কথা চিন্তায়ও আনেন না।
এসব জাহাজ যখন চার-পাঁচটা একই সঙ্গে কোনো অভয়ারণ্যে হাজির হয়, হাজারখানেক মানুষ জঙ্গলে নামে, তখন অভয়ারণ্য আর অভয়ারণ্য থাকে না, ভয়ংকর স্থান হয়ে ওঠে। অভয়ারণ্যের সাত-আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে এই অনিয়ন্ত্রিত যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতে শুধু বন কর্মচারীরাই সমস্যায় পড়েন না, পশুপাখি ও পেশাদার পর্যটন প্রতিষ্ঠানের যাত্রীরাও উত্ত্যক্ত হয়ে ওঠেন।
একটা বিষয় সবার কাছেই দুর্বোধ্য—অভয়ারণ্যগুলো ঘোষণা করা হয়েছে যেখানে, সেখানে শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা যাবে। এলাকাটি পশুপাখিদের জন্য নিরুপদ্রব থাকবে। বিশেষ প্রবেশ ছাড়া সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। অথচ এই অভয়ারণ্যেই সব পর্যটককে হাজির করা হয়।
পর্যটকদের আকর্ষণ করার উপযোগী অনেকগুলো এলাকা রয়েছে, যে এলাকাগুলো অভয়ারণ্যের পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর একটি এলাকা হচ্ছে—শরণখোলা রেঞ্জের কোকিলমুনি এলাকা। এখানকার বন অফিসের পূর্ব দিকে একটি গরান বন আছে। বনটির কিছুটা অংশ ফাঁকা করে ঘাস বুনে দিলে এলাকাটা হরিণ এবং অন্যান্য প্রাণীর চমত্কার চারণভূমি হয়ে উঠবে। এখানে ওয়াচ টাওয়ার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা যেতে পারে। যাত্রীদের ওঠানামার জন্য এখানে জেটি তৈরি জরুরি। জাহাজ রাখার জন্য বন বিভাগ এখানে জলের মধ্যে গাছ পুঁতে দিতে পারে। এখানে অন্তত একসঙ্গে চারটি জাহাজের যাত্রীদের বন ভ্রমণ করানো সম্ভব। এই এলাকার কাছাকাছি রয়েছে নয়নাভিরাম তিনকোন দ্বীপ। দ্বীপে ঢোকার জন্য অনেকগুলো ছোট-বড় খাল রয়েছে। এই খালগুলোতে ঢুকে যাত্রীরা মহানন্দে বনের অভ্যন্তরে পশুপাখি দেখতে পাবেন। তিনকোনার পূর্ব পারেও কিছু খাল আছে। পূর্ব পারের দক্ষিণের ঘাসের জঙ্গলটি চমত্কার। এখানেও একটি ওয়াচ টাওয়ার করা যেতে পারে।
মধ্যসুন্দরবনে নলিয়ান রেঞ্জে আরেকটি চমত্কার ভ্রমণ উপযোগী এলাকা হচ্ছে হংরাজ ক্যাম্প এলাকা। এ এলাকার ভ্রমরখালী, পাটকোষ্টা এলাকায় পর্যটকেরা ভাগ হয়ে বনের সৌন্দর্য দেখতে পারেন। হংরাজ ক্যাম্পকে ভ্রমণ কেন্দ্রে উন্নীত করা যেতে পারে। এখানেও ওয়াচ টাওয়ার, তারজাল ঘেরা ওয়াকওয়ে করা যেতে পারে।
পশ্চিম সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জের কালীরচর অসাধারণ নিসর্গসুন্দর, জীবজন্তুসমৃদ্ধ এলাকায়। এ এলাকা চমত্কার পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার দাবিদার। এই এলাকাকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী ঝালিয়া ক্যাম্প, দুবেকি ক্যাম্পকে পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীত করা যেতে পারে।
এসব এলাকায় জাহাজ রাখার ব্যবস্থা, যাত্রীদের বনে ওঠানামার সুব্যবস্থা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে অভয়ারণ্যগুলো বেঁচে যায়। সেই সঙ্গে বনযাত্রীরাও বনের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এতে রাজস্বও অনেক বাড়বে। তবে মৌসুমি পর্যটন আয়োজনের জাহাজগুলোকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষিত করার জন্য বন বিভাগ পুস্তিকাও প্রকাশ করতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই বনের শান্তি বজায় রাখা হয়। আমরা অন্যগ্রহে বসবাস করছি না। আর সুন্দরবনই হচ্ছে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার একমাত্র জঙ্গল।
খসরু চৌধুরী: বন বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.