বিয়ে :ধর্মীয় ও পবিত্র বন্ধন by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

মানবজীবনে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বিয়ে মানুষকে দায়িত্ববান করে তোলে। জীবনে এনে দেয় স্বস্তি ও প্রশান্তি। বিয়ের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সক্ষম হয় যাবতীয় পাপাচার ও চারিত্রিক স্খলন থেকে দূরে থাকতে। অব্যাহত থাকে বিয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে মানবসভ্যতার ধারা। বৈধ পন্থায় মানুষ সংসার গঠন করে বিয়ের মাধ্যমে।


এক কথায় বিয়েতে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ। ইসলাম ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মেও রয়েছে বিয়ের বিধান। প্রত্যেক ধর্মই বিয়ে সম্পর্কে মানুষকে উৎসাহিত করে কিছু বিধান পেশ করেছে। বিয়েবহির্ভূত কোনো সম্পর্ক কোনো ধর্ম কখনও স্বীকার করে না।
বাংলাদেশে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইন, ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন প্রভৃতি আইনের সমন্বিত নিয়ম ও ধারার অধীনে মুসলমান সমাজে আইনি বিয়ে ও আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন হয়। অবশ্য এসব আইনের সবই যে ইসলামী শরিয়তভুক্ত তা বলা যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষ শরিয়ত পরিপন্থী অনেক কাজ এতে যোগ হয়েছে। মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ে একটি ধর্মীয় দায়িত্বই কেবল নয়, তা একটি দেওয়ানি চুক্তিও বটে। মুসলিম বিয়েতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন : উভয়পক্ষের বয়স, পারস্পরিক সম্মতি, দেনমোহর ও সুস্থ মস্তিষ্কের প্রাপ্তবয়স্ক দু'জন সাক্ষী।
এ ছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে পুরোহিত মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে বিয়ে পড়ান, তারপর আগুন সাক্ষী রেখে ৭ চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া হিন্দুশাস্ত্র মতে 'দৈব বিবাহ'ও হয়ে থাকে। যাতে কন্যার বাবা মন্দিরে ঈশ্বরকে সাক্ষী করে মেয়েকে তার জামাতার হাতে তুলে দেন। বৌদ্ধ ধর্মে মন্ত্র আউড়ে বিয়ে সম্পন্ন করেন বৌদ্ধ ভিক্ষু। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে হয় গির্জায় ফাদারের উপস্থিতিতে। ফাদার বাইবেল থেকে পাঠ করে দম্পতির সম্মতি জানান এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এ তো গেল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের বিষয়। সব ধর্মেই এটি স্পষ্ট, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করতে পারবে না। তারপরও বিয়ে হচ্ছে ধর্মান্তরের মাধ্যমে। বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনে বিয়ের একপক্ষ মুসলমান হলে, অপরপক্ষ যদি মুসলমান হতে রাজি হয় তাহলে তা বৈধ বিয়ে; কিন্তু অপরপক্ষ মুসলমান হতে রাজি না হলে তা 'অনিয়মিত বিয়ে' বলে গণ্য হবে। যদিও আহলে কিতাবদের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি ভিন্ন। খ্রিস্টান আইনেও একই বিধান। আমাদের জানা না থাকলেও ধর্মান্তর, ধর্মকে বাদ দিয়ে আলাদা একটি আইন আছে, যা 'বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২' নামে খ্যাত।
বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে উভয় পক্ষকেই স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করতে হয় এবং তা বাধ্যতামূলক। ১৮৭২ সালের এ আইনের অধীনে বিয়ে হলে (জাতিগত অসামর্থ্যতা দূরীকরণ আইন-১৮৫০ অনুসারে) হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো পরিবারের উক্ত সদস্য স্বীয় ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য হবেন।
এখন এই বিশেষ বিবাহ নিয়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। খবরে প্রকাশ, নিজ ধর্ম বিশ্বাস বাদ দিয়ে যেসব নারী-পুরুষ বিবাহ করতে আগ্রহী তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি করতে গত ১৮ এপ্রিল একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতদিন এই বিয়ে পড়াতেন পুরান ঢাকার একজন আইনজীবী। নতুন একজন আইনজীবীকে নিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ বিবাহের বিষয়টি আলোচনায় আসে। দেশের আলেম সমাজের দাবি, এভাবে আন্তঃধর্মীয় বিয়ের বা ধর্ম বাদ দিয়ে বিয়ের আইন পাস ও ব্যবস্থা করা সরাসরি ইসলাম পরিপন্থী কাজ। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও আলেম সমাজের মাঝে চলছে বিরোধ। দেশের আলেমরা আন্তঃধর্মীয় বিয়েকে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করলেও সরকার বলছে প্রস্তাবিত আইনে ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। এমতাবস্থায় গত সোমবার আইন মন্ত্রণালয় থেকে এই বিশেষ বিবাহ আইন সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বিশেষ বিবাহ আইনটি ১৮৭২ সালে প্রণীত। এ আইন এখনও বিদ্যমান। বর্তমান সরকারের সময় এ আইনের কোনো ধরনের সংশোধন হয়নি। আইনটি অপরিবর্তিত অবস্থায় বহাল আছে। তাই সরকার ও আইমন্ত্রীর বিয়ে-শাদি থেকে ধর্ম বাদ এবং সন্তানের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই বলে আইন পাস করার বক্তব্য ভিত্তিহীন।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইনে বলা হয়েছে_ যেসব ব্যক্তি খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ অথবা জৈন ধর্মের অনুসারী নয় এবং যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ অথবা জৈন ধর্মের অনুসারী তাদের কতিপয় বিয়ে আইনসম্মত করার লক্ষ্যে এ আইন করা হয়েছে। এ আইন কোনোভাবেই মুসলিম বিবাহ আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এ আইনের অধীনে সরকার বিশেষ বিবাহ নিবন্ধকের লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। এ আইনের অধীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত বিবাহ নিবন্ধক কোনো মুসলমানের বিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন না। এই আইনের অধীন নিবন্ধিত দম্পতিদের ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
মানুষ সমাজে একে অন্যের সাহচর্য নিয়ে বাস করে। পরিবার ও সমাজ ছাড়া একাকী বসবাস করা ভীষণ কষ্টকর ব্যাপার। ছোট থেকে যুব ও পরিণত বয়সে সুখ-দুঃখ, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রূষাসহ সব কাজ পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধনের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের জন্য প্রয়োজন পবিত্র ও সভ্য সামাজিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার মধ্যে থাকা চাই পরিপূর্ণ ও সব পর্যায়ে মঙ্গলকর নির্দেশনা। এক্ষেত্রে ধর্ম পালনের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা জানি, নারী-পুরুষের দেহ ও আত্মার বন্ধন দাম্পত্য জীবন। পারস্পরিক বৈধ ও পবিত্র পন্থায় সুখানুভূতির জন্য বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনের যাত্রা শুরু হয়। দুটি মনের যুগল বাঁধনের সার্থক পরিণতি সন্তান-সন্ততি নিয়ে সুখের সংসার। এ পটভূমিতে যদি ধর্মকেই অস্বীকার করা হয় তাহলে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়।
তবে এটা ঠিক, বিশেষ বিবাহ আইন স্পষ্টত সব ধর্মবিরোধী জটিল একটি আইন। আইন বানানো হয় জটিলতা কমাতে কিন্তু সেই আইনই যদি জটিলতা সৃষ্টি করে তাহলে সেটা অবশ্যই মানব কল্যাণমুখী এটা বলা যাবে না। আমরা চাই সরকার দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে এমন আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেবে।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.