সদরে অন্দরে-আর কত নূরজাহানের জন্ম দেবে এই সমাজ by মোস্তফা হোসেইন

জীবিত একজন মানুষকে গলা অবধি মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মারা, জোর করে নারীর চুল কেটে তার গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে গ্রামে ঘোরানো, সন্তানের সামনে বাবার মাথায় চুনকালি মেখে মজলিসের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা কিংবা তরুণীর আর্তনাদকে উপেক্ষা করে বেতের আঘাতে জর্জরিত করার মতো বর্বরোচিত দৃশ্যগুলো এখনো আমাদের সমাজে অতীত হয়ে যায়নি।


আরো দুঃখজনক হচ্ছে, এগুলো প্রায় সবই হয় ফতোয়ার নামে। যার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় পবিত্র ধর্ম ইসলাম। ব্যবহার হয় দুর্বল শ্রেণী বিশেষ করে নারীর ওপর, ব্যবহার করে প্রভাবশালী আর নির্যাতকরা। কী দুর্বিষহ চিত্র একেকটি আমাদের দেখতে হয় আজও। আজও আমাদের আত্মজিজ্ঞাসিত হতে হয়- সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও কি আমাদের নিবৃত্ত করতে পারে না? ২০০১ সালে আদালতের রায় ঘোষিত হয় ওই ধরনের ফতোয়ার বিরুদ্ধে। তারপর ফতোয়াবাজদের পক্ষ থেকে আপিল করা হলে সেখানেও স্পষ্টত বলে দেওয়া হয়, ফতোয়ার নামে কোনো নাগরিককে এমন কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না, যা তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত হানে। কিংবা এমন কোনো ফতোয়া দেওয়া যাবে না, যা অভিযুক্ত ব্যক্তি মানতে বাধ্য হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তার পরও আমাদের দেখতে হয় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সৈয়দ দামগারা গ্রামের আবদুর রশিদ ও তাঁর পুত্রবধূ সালমা বেগমকে মাথা মুড়িয়ে মারধর করে গ্রামময় ঘোরানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে বোঝা যায় স্পষ্টত। আবদুর রশিদের ছেলে জাকির মণ্ডল এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বলেছেন, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর বাবা সম্পর্কে অনৈতিক কাজের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। জাকির মণ্ডলের এই বক্তব্যের পর প্রমাণিত হয় এ ঘটনাটি 'যার বিয়া তার খবর নাই, পাড়া-পড়শির ঘুম নাই' প্রবাদের মতো। যে বা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা; তাদের কোনো অভিযোগ নেই, মাঝখান থেকে পাড়া-পড়শিরা এসে ফতোয়া বা মেল-মাহফিল করে আবদুর রশিদকে শাস্তি দিয়ে বসেছে। এ ঘটনা ঘটেছে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে।
সমসাময়িক ঘটনায় দেখা যায়, যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার মজিদপুর গ্রামের ইয়াকুব আলী নামের এক ব্যক্তিকে ঋষিপাড়ার সখির সঙ্গে কথা বলতে দেখে ধরে নিয়ে যায়। সেখানেও এই দুজনকে বেঁধে মারধর করা হয়। সখি ও ইয়াকুব আলীর চুল কেটে নেয় সালিসের নামে। ঘটনার পেছনের ঘটনা হিসেবে জানা যায়, ওই ইয়াকুব আলী স্থানীয় ইউপি মেম্বারকে গত নির্বাচনে ভোট দেননি এবং তিনি মেম্বারের প্রতিপক্ষের হয়ে নির্বাচনে কাজ করেছেন। তারই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে স্থানীয় মেম্বার এমন অমানবিক কাজটি করেছেন।
এ ধরনের ফতোয়ার পেছনে নিশ্চিতভাবে কাজ করে প্রভাবশালী কিংবা দুর্বৃত্তদের শোষণমূলক কোনো আকাঙ্ক্ষা। বগুড়ার এ ঘটনার পেছনে কাজ করেছে স্থানীয় কিছু বখাটের কু-প্রবৃত্তি। জাকিরের স্ত্রীর ইজ্জত নষ্ট করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এই নৃশংস নাটকের জন্ম দিয়েছে।
যেখানেই ফতোয়া, সেখানেই দেখা যাবে নিম্ন আয়ের মানুষ তার শিকার। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সেরুয়া দহপাড়া গ্রামের হাসিনা খাতুন দোররা খেলেন। তিনি ছিলেন চালকলের শ্রমিক। স্বামী পরিত্যক্তা এই মহিলা ওই মিলেরই শ্রমিক করিম উদ্দিনের সঙ্গে প্রেম করেন। আদালতে গিয়ে বিয়েও হয় তাঁদের। এটা কি অপরাধ? কিন্তু তার জন্যই হাসিনাকে ১০১ ঘা দোররা খেতে হলো। করিম উদ্দিনও বাদ যাননি। তবে পুরুষ বলে হয়তো তাঁকে খেতে হয় ৫০ ঘা।
২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে পাবনার ভাঙ্গুড়ায় এক ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতাকে ১০১ দোররা মারা হলো। ধর্ষকের গায়ে বেতের ঘা পড়েনি একটিও। শুধু ৮০০ টাকা জরিমানা দিয়ে ধর্ষক পূত-পবিত্র(!) হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায় স্থানীয় মসজিদের ইমামের ফতোয়া অনুযায়ী। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়ার পাবুর গ্রামের এক তরুণীকে দোররা মারার শাস্তি দেওয়া হয়; কিন্তু তাঁর চাচাতো ভাই কামাল ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। শুধু তা-ই নয়, গ্রামের মানুষকে না জানিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে মেয়েকে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার অপরাধে রাজশাহীর তানোরের ভ্যানচালক আনসার আলীকে ৪০ দোররা খেতে হয়, জরিমানা দিতে হয় ৭০০ টাকা ও ১০ কেজি মিষ্টি।
এ ধরনের বিচার ফতোয়া কিংবা সালিসের নামে যে অবিচার-নির্যাতন হয়, সেখানে বিষয় হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌনতাকে টেনে আনা হয়।
আমাদের মনে থাকার কথা শরীয়তপুরের হেনার কথা। আমাদের জাতীয় কলঙ্ক হিসেবে শক্ত ভিত তৈরি করে রেখেছে মৌলভীবাজার জেলার ছাতকছড়ার নূরজাহানের আত্মহত্যার কথা। নূরজাহানকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার এই নৃশংসতা আমাদের গল্প-উপন্যাসেও স্থান পেয়েছে। এত কিছুর পরও নূরজাহানদের সংখ্যা কি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে?
সালিস কিংবা ফতোয়া নামের প্রাচীন এই সামাজিক প্রথার অপব্যবহার সচেতন মানুষের বিবেকে নাড়া দেওয়ার কারণেই বোধ করি মাত্র এক যুগ আগে এ দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি।
সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এই ফতোয়া সংবিধানের এই ধারাগুলোকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের এই বক্তব্য আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন বলবৎ থাকার কারণেও ফতোয়াবাজি দেশে বেআইনি। আর তাই ফতোয়াবাজির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধির ৪৯৪, ৫০৮ এবং ৫০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে থাকে।
ফতোয়ার ওপর হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে যে আপিল হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টও যে রায় প্রদান করে, তা জনগণের সামনে যতটা উপস্থাপিত হওয়া উচিত ছিল তেমনি হয়নি বলেই আজকে বগুড়ার মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই ফতোয়ার নির্যাতন চলে আসছে। দেশ থেকে ফতোয়াবাজি দূর করতে হলে সরকারকে জনসচেতনতা বৃদ্ধির দিকে অধিকতর নজর দিতে হবে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কিছু উদ্যোগ নিলেও কোন কারণে তারাও প্রচারব্যবস্থাকে গুটিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, নারীশিক্ষার প্রসার এবং তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব না হলে এই নির্যাতনের মূলোৎপাটন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
নূরজাহান, হেনা, হাসিনা কিংবা সখিদের সংখ্যা কত বাড়বে এই সমাজে। সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। সখিরা যদি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়, হেনারা যদি অর্থ নয় ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে একত্র হয়, তাহলে ওই শোষকদের হাত ভেঙে যাবে। অন্তত ধর্মের নামে, সমাজের দোহাই দিয়ে কুপ্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করতে তাদের গা কাঁপবেই।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.