চিরকুট-চেনা-অচেনা হাসপাতাল by শাহাদুজ্জামান

এক অর্থে হাসপাতাল জগত্ সবারই চেনা। নিজে রোগী হয়ে কিংবা রোগীকে সাক্ষাত্ করতে গিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অল্পবিস্তর আছে সবারই। আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি যে হাসপাতাল চিকিত্সাসেবার একটি প্রতিষ্ঠান হলেও এর একটি স্বতন্ত্র সামাজিক পরিমণ্ডল আছে। হাসপাতাল এক স্বয়ম্ভু পৃথিবী।


এর একটি নির্ধারিত পরিধি আছে, সেখানে আছেন এর নিয়মিত বাসিন্দা ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয় প্রমুখ, আছেন এ পরিধির অস্থায়ী বাসিন্দা রোগীরা। এ পৃথিবীর আছে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন, মূল্যবোধ, আচার-বিধি, আছেন এর গোষ্ঠীপ্রধান। সব মিলিয়ে হাসপাতালের রয়েছে নিজস্ব একটি সংস্কৃতি। নাজুক শরীর, জীবন, মৃত্যুর নাগরদোলা, উত্কণ্ঠা, আনন্দ, কর্তৃত্ব, ক্ষমতাহীনতা ইত্যাদি মিলিয়ে হাসপাতাল-জীবনের রয়েছে এক বিচিত্র চরিত্র। চিকিত্সা পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাজের ক্ষেত্র হলেও হাসপাতাল আকৃষ্ট করেছে সমাজবিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিকদেরও। বিশ্বসাহিত্যের অনেক বিখ্যাত গল্প উপন্যাস রচিত হয়েছে হাসপাতাল-জীবনকে কেন্দ্র করে। চেখভের ওয়ার্ড নাম্বার সিক্স, আলেকজান্ডার সলঝিনিিসনের ক্যান্সার ওয়ার্ড, টমাস মানের ম্যাজিক মাউন্টেন হাসপাতাল-জীবনের ওপরই ভিত্তি করে রচিত। আমাদের লেখক হাসান আজিজুল হকের পাতালে হাসপাতালের কথাও মনে পড়বে আমাদের। আমি হাসপাতালের সমাজজীবন নিয়ে গবেষণা করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি বিদ্ধস্ত হাড় নামে। গবেষণার সূত্র ধরে চেনা হাসপাতালের অচেনা মাত্রাগুলোকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি।
হাসপাতালের ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখি, হাসপাতালের যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি আমরা আজ দেখতে পাই এর শুরু মূলত ইউরোপে এবং এর ভিত্তি খ্রিষ্টীয় ‘চ্যারিটি’ বা দানের ধারণা থেকে। ইংরেজি হসপিটাল শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘হসপিটালিস’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘অতিথি’। চার্চের উদ্যোগে পশ্চিমা পৃথিবীতে মধ্যযুগের আগে যে হাসপাতালগুলো তৈরি হতো সেগুলো মূলত ছিল এক ধরনের অতিথিশালা। ইউরোপে দশম, একাদশ শতকে যে হাসপাতালগুলোর খোঁজ পাওয়া যায় তাতে কেবল রোগীরাই থাকতেন না, থাকতেন তীর্থযাত্রী, পঙ্গু, ভবঘুরে এমনি বিচিত্র মানুষ। তখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হতো চার্চ দ্বারা এবং ধর্মীয় বিধিবলে। রোগও বিবেচিত হতো একটি আধ্যাত্মিক ঘটনা হিসেবে। চিকিত্সার অংশ হিসেবে রোগীরা তাই প্রার্থনায় বসতেন সেই অতিথিশালায়। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে রেনেসাঁর পর যখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে রোগ এবং চিকিত্সাও যুক্তি এবং বিজ্ঞানের আওতায় চলে আসে। ধর্মীয় বাধামুক্ত হয়ে মানুষ প্রথমবারের মতো শরীর ব্যবচ্ছেদ করে এর ভেতরের রহস্য বোঝার চেষ্টা শুরু করে। সেই সঙ্গে হাসপাতালের চেহারাও যায় বদলে। আধ্যাত্মিক প্রভাবমুক্ত হয়ে হাসপাতাল হয়ে ওঠে একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি হাসপাতাল পরিণত হয় চিকিত্সাবিদ্যা চর্চার একটি ক্ষেত্রে, রোগীরা হয়ে ওঠে বিদ্যাচর্চার মাধ্যম। উল্লেখ্য সতেরো, আঠারো শতকের পশ্চিমা দুনিয়ায় হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে যেতেন মূলত দরিদ্র রোগীরা, ধনবানেরা চিকিত্সা নিতেন বাড়িতেই। আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের টেক্সটগুলো ফলে গড়ে উঠেছে মূলত দরিদ্র মানুষের দেহকে গবেষণার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমেই। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তার বার্থ অব দি ক্লিনিক বইয়ে হাসপাতাল এবং মেডিকেল শিক্ষার বিকাশের এই অধ্যায়ের ওপর আলোকপাত করেছেন।
তবে আমাদের অঞ্চলে আধুনিক হাসপাতালের ইতিহাস খানিকটা ভিন্নতর। এখানে হাসপাতাল গড়ে উঠেছে মূলত দুটো শক্তির প্রভাবে, এক. খ্রিষ্টান মিশনারি এবং দুই. ব্রিটিশ কলোনাইজার। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতকে মিশনারিরা ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে প্রচুর হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন মূলত চিকিত্সাসেবার সুবাদে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এখনো আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া যাবে প্রাচীন মিশনারি হাসপাতাল। পবরর্তীকালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরাও এ দেশে গড়ে তুলেছেন বিস্তর হাসপাতাল। ভারতবর্ষের প্রথম মেডিকেল কলেজটিও প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা। তাঁদের উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ভিন্ন। উপনিবেশ রক্ষার স্বার্থে তাঁদের প্রয়োজন ছিল সুস্থ স্থানীয় শ্রমশক্তির, সেই সঙ্গে নানা রোগ-বালাইয়ের দেশ ভারতবর্ষে এসে ব্রিটিশ প্রশাসকদের প্রয়োজন ছিল রোগমুক্ত থাকার, ফলে চিকিত্সা ব্যাপারটির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়েছিল ব্রিটিশ কলোনাইজারদের। গ্রামগঞ্জে রুরাল ডিসপেনসারি তৈরি করেছিলেন তাঁরা, বড় শহরগুলোতে তৈরি করেছিলেন হাসপাতাল। এই হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে ব্রিটিশরা তাঁদের ঔপনিবেশিক শাসনের একটি মানবিক চেহারা দিতেও সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৮৭ সালের ইন্ডিয়ান মেডিকেল জার্নালে এক ব্রিটিশ জেনারেল লিখছেন, ‘ইন্ডিয়ান ফ্রন্টে আমাদের ডিসপেনসারিগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার হাজার বেয়োনেটের চেয়েও এগুলো শক্তিশালী। এই ডিসপেনসারিগুলোর মাধ্যমে আমাদের পক্ষে নেটিভদের মন জয় করা সহজ হয়েছে।’
ইতিহাসের নানা বাঁক ঘুরে হাসপাতাল এখন উন্নত-অনুন্নত উভয় দেশেরই চিকিত্সার অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। বিবর্তিত হয়েছে এর রূপ। ক্রমেই এটি পরিণত হয়েছে একটি শহুরে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে। কেউ কেউ হাসপাতালকে তুলনা করেছেন ফ্যাক্টরির সঙ্গে। অসুস্থ রোগী কাঁচামাল হিসেবে হাসপাতাল নামক ফ্যাক্টরিতে ঢোকে, যে ফ্যাক্টরি পণ্য হিসেবে উত্পাদন করে হয় সুস্থ নয়তো মৃত মানুষ। বলাবাহুল্য আধুনিক হাসপাতাল একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বটে। আজকাল অনেক আধুনিক হাসপাতালের সঙ্গে পাঁচতারা হোটেল কিংবা কোনো করপোরেট অফিসের পার্থক্য করা দুরূহ।
বলার কথা এই যে হাসপাতালের চেনা রূপের বাইরে এর অনেক অচেনা ছদ্মবেশী রূপও আছে। যে রূপের রূপান্তর ঘটেছে কালে কালে। হাসপাতাল ছিল অতিথিশালা, ধর্মপ্রচারের মাধ্যম, এমনকি ঔপনিবেশিকতার অস্ত্রও। সেই ধারাবাহিকতায় হাসপাতাল ক্রমেই পরিণত হচ্ছে একটি ব্যবসাকেন্দ্রে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.