নির্বাচিত স্বৈরশাসকরা by এম আবদুল হাফিজ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক স্বৈরশাসকদের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পথ ধরেই এ দেশে স্বৈরশাসনের সূচনা, যদিও বাকশালী একদলীয় শাসনের প্রবর্তনই তার প্রারম্ভিক পদক্ষেপ। সামগ্রিক বিচারে স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই আমরা কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফাঁদে ফেঁসে যাই।


সমগ্র মুক্তিসংগ্রামের মূলমন্ত্র গণতন্ত্রকে শাসন শকটের পেছনের আসনে ঠেলে দেওয়া হয় এবং চালকের আসনটি দখল করে কর্তৃত্ববাদ ও স্বেচ্ছাচার। স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সংগ্রামে আপামর জনগণের গণতন্ত্রে দীক্ষা কর্তৃত্ববাদকে গণতন্ত্রের মুখোমুখি এক সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করায়। অতঃপর কোনো না কোনো আঙ্গিকে এই সংঘর্ষের প্রকাশ ঘটেছে। আরও অনেক বছর পরে যখন ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, আমরা না হোক, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের সংঘাত সম্বন্ধে অনেক কিছু জানবে।
আজ লিখতে বসেছি প্রচণ্ড জনপ্রিয় এবং বিপুলভাবে নির্বাচিত স্বৈরশাসকদের নিয়ে, যাদের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। কেননা তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সামরিক স্বৈরশাসকদের মতো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী নয়। তারা অন্তহীন স্বেচ্ছাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা যায় না। করলে তা গণতন্ত্রবিরোধিতা বলেই পরিগণিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তা নির্বাচিত সরকার উৎখাতের আন্দোলন বলে পরিগণিত হয় এবং সচেতন সমাজের প্রখর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
আমাদের সর্বশেষ সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা দলমত নির্বিশেষে এক যুগ ধরে আন্দোলন করেছিলাম। সেই সময়ই সম্ভবত খালেদা-হাসিনা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে পরস্পরের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়েছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একটি সর্বজনীনতা ছিল। যেহেতু তিনি সামরিক স্বৈরশাসক এবং তার লুটপাট ও চারিত্রিক বিকৃতিও কম ছিল না, তাই এক যুগের আন্দোলনেও কদাচিৎ তাতে ভাটা পড়েছে। বরং সে আন্দোলন প্রলম্বিত হলেও জমেছিল বেশ।
এরশাদের পতনের পরই আমরা উপলব্ধি করলাম যে, তার পতন কিন্তু স্বৈরাচারের সমাপ্তি ঘটায়নি। এখনও তা আরও তীব্রভাবে বলবৎ আছে। স্বৈরাচারের উপসর্গ গুলি-নির্যাতন, দুর্নীতি-অনিয়ম, জনমতের বিরুদ্ধাচরণ ইত্যাদি এখনও বহাল-তবিয়তে। কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে আর আগের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। তা করতে গেলেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারীরূপে শনাক্ত হতে হয়। গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত জিগির তোলা হয়। গণতন্ত্রের মন্ত্রে সেই প্রাক-স্বাধীনতা আমল থেকেই দীক্ষিত এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশে নূর হোসেনের মতো জেনেশুনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মতো তরুণ বৈতালিকের অভাব নেই। তাই গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারের চর্চাকারীরা সহজেই পার পেয়ে যায়।
১৯৯১-এর পর এ দেশে যে ক'টি এবং যে দলেরই শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সবাই কমবেশি স্বৈরাচারী ছিল, অন্তত তাদের আচার-আচরণে। দেখাই যাক একবার নিকট অতীতের চারদলীয় জোট এবং চলমান মহাজোট সরকারের শাসনশৈলী। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট একটি অযোগ্য সরকার হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল। সরকারের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ওই সময় জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল। দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণহীনতা ছাড়াও ওই সময়ই বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট প্রকট হয়েছিল। একটি কোণঠাসা বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তখন জোট সরকার উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এখনকার ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবের মতো আওয়ামী লীগের আবদুল জলিল তখনও সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। রাজধানী তখন প্রকৃতপক্ষে রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এক অনাকাঙ্ক্ষিত এক-এগারোয় তার পরিণতি ঘটেছিল; কিন্তু জোট সরকারের পতন হয়নি। এর কারণ সম্ভবত একটাই। যতই অগণতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারীই হোক না কেন জোট সরকার জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটি নির্বাচিত সরকার ছিল। ওই একই বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যতই চেষ্টা করুক না কেন মহাজোট সরকারের পতন একই কারণে ঘটাতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, মহাজোটকে হয়তো খানিকটা বিক্ষত-বিপর্যস্ত করা অসম্ভব নয়, কিন্তু মহাজোটের পতন ঘটানো অসম্ভব। কেননা মহাজোট সরকার তো জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটি নির্বাচিত সরকার। তার মেয়াদকালে এই সরকার টিকে থাকবে। জনগণ যতই সরকারের বিরুদ্ধে রুষ্ট থাকুক না কেন তারা এটুকু বোঝে যে, সরকার পতনের ঐতিহ্য শেষ পর্যন্ত কোনো ভালো ঐতিহ্য নয়। তবু সান্ত্বনা এটাই যে, এই স্বৈরশাসকদের মেয়াদ উত্তীর্ণের পর বিনা আন্দোলনেই কেটে পড়তে হয় গণতন্ত্রেরই বদৌলতে।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.