শিক্ষা-সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাবে by গাজী মো. আহসানুল কবীর

সৃজনশীলতা মানুষের একটি অন্তর্নিহিত গুণ। মানুষের এ সুপ্ত সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়, নানা বিষয় সন্নিবেশ করা হয়। ফলে প্রত্যেক শিক্ষার্থী এমনভাবে গড়ে ওঠে যে কর্মজীবনে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সৃজনশীলতার ছাপ রাখতে পারে।


কিন্তু আমরা এখনো বাংলাদেশে সে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানে দক্ষতা বিনির্মাণে একের পর এক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমরা চলছি মুখস্থ বিদ্যানির্ভর বিশ্ব দরবারে প্রায় অচল একটি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। এ পদ্ধতিতে মেধার কোনো মূল্যায়ন হয় না, সৃজনশীলতা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। এ সংকট থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন উদ্যোগের সফল সূচনা। সূচনা ইতিমধ্যে হয়ে গেছেও। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক স্তরে এসএসসি পরীক্ষায় মূল্যায়ন পদ্ধতি সংস্কার করে নতুন সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। সরকারি ঘোষণা অনুসারে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথমপত্র ও ধর্ম—এ দুটি বিষয়ের পরীক্ষা সৃজনশীল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ২০১১ সালে আরও পাঁচটি বিষয় (রসায়ন, ভূগোল, সাধারণ বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ব্যবসায় উদ্যোগ) এবং পরবর্তী বছর অবশিষ্ট বিষয়গুলোয় সৃজনশীল প্রশ্নপত্র অনুসারে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
সব নতুনই মানুষের কাছে অপরিচিত মনে হয়। তাই এ নতুন পদ্ধতি সম্পর্কেও এক অজানা আশঙ্কা ও ভীতি শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষকসহ সবার মনেই কাজ করছিল। কিন্তু মনে হয়, এ ভীতি এরই মধ্যে কেটে গেছে। কারণ গত আগস্ট মাসে সারা দেশব্যাপী বাংলা ও ধর্মশিক্ষায় একই প্রশ্নপত্রে (সৃজনশীল) সব শিক্ষার্থী প্রাক-নির্বাচনী (প্রিটেস্ট) এবং পরে গত অক্টোবরে নির্বাচনী (টেস্ট) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দেখতে পেল, এ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি দারুণ এক শিক্ষার্থী-বান্ধব পদ্ধতি।
সৃজনশীল প্রশ্নের যে চারটি অংশ থাকে তার সবটুকুই শিক্ষার্থীরা নিজেরাই উত্তর দিতে পারে। এর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে বিরক্তির সঙ্গে মুখস্থ করার প্রয়োজন পড়ে না, সাহায্যের জন্য কারও কাছে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। শুধু পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু গল্পের বইয়ের মতো পড়ে নিলেই চলে। নিজে নিজেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারে শিক্ষার্থীরা। আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে চিন্তাশক্তির প্রয়োগে এবং সমস্যা সমাধানে পারদর্শী অর্থাত্ সামগ্রিকভাবে সৃজনশীল করে গড়ে তোলার জন্যই নতুন এ পদ্ধতি। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে দুটি অংশ থাকে। তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় প্রথম অংশে ৬০ নম্বর এবং দ্বিতীয় অংশে ৪০ নম্বর। প্রথম অংশে ছয়টি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের উত্তর করতে হয় (নয়টির মধ্যে) এবং দ্বিতীয় অংশে ৪০ নম্বরের জন্য ৪০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর করবে। প্রথম অংশে প্রতিটি ১০ নম্বরের কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের শুরুতে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য প্রথমে একটি দৃশ্যকল্প (প্যারাগ্রাফ বা চিত্র বা ছক) দেওয়া থাকে। তারপর এর ওপর চারটি প্রশ্ন করা হয় সহজ থেকে ক্রমান্বয়ে কঠিনের দিকে যথাক্রমে ১ নম্বর, ২ নম্বর, ৩ নম্বর ও ৪ নম্বরের অর্থাত্ মোট ১০ নম্বরের প্রশ্ন। এ চারটি প্রশ্নের প্রথমটি স্মৃতিনির্ভর, বইতে যা পড়েছে তা স্মরণ করে উত্তর লিখবে। দ্বিতীয় অংশে শিক্ষার্থী বস্তু বা বিষয়টি সম্পর্কে কতটুকু বুঝতে পারল তা যাচাই করার জন্য একটি সহজ প্রশ্ন করা হয়। এর পর প্রশ্নের তৃতীয় অংশে জানতে চাওয়া হয় সে এ বস্তু বা বিষয়টি সম্পর্কে যা জানল ও বুঝল তা নতুন পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজে লাগবে অর্থাত্ তার অরিচিত কোনো ক্ষেত্রে তার লব্ধ জ্ঞানটি কীভাবে প্রয়োগ করবে এবং সর্বশেষ চতুর্থ অংশে বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীর কিছু বিশ্লেষণধর্মী মতামত ও মূল্যায়ন বা তার কাছ থেকে সমস্যার একটি সমাধান চাওয়া হয়। অর্থাত্ এ পদ্ধতিতে চারটি ছোট প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে তিলে তিলে একজন সৃজনশীল মানুষ তৈরি করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।
অনেকে মনে করতেন, এ ধরনের বিশেষণমূলক মতামত বা সমস্যার সমাধান কি শিক্ষার্থীরা দিতে পারবে? তাদের জন্য এটি কঠিন হয়ে যাবে না তো? কিন্তু না, দেখা গেছে, পরীক্ষার্থীরা নিজের মতো করে মতামত দিচ্ছে বা সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। আর ‘আমিও সমাধান দিতে পারি’ এ অনুভূতি শিক্ষার্থীদের দারুণভাবে উদ্বেলিত করে। শিক্ষা সংস্কারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম উপলক্ষে দেশের কিছু কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয় পরিদর্শনের সুযোগ আমার হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে শিক্ষার্থীদের সাড়া দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছি। এটি সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির সফলতা সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট আশাবাদী ও আস্থাশীল করে তুলেছে।
এ ব্যাপারে বলে রাখা ভালো যে বর্তমানে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির তুলনায় সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিতে মূল্যায়ন অনেক বেশি নির্দোষ, সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য। যেমন, বর্তমান পদ্ধতিতে কোনো বিষয়ের একটি প্রশ্নপত্রে একই অধ্যায় থেকে একাধিক প্রশ্ন করা যায়, আবার কোনো কোনো অধ্যায় থেকে হয়তো একটিও প্রশ্ন না করেও থাকা যায়। কিন্তু প্রস্তাবিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে একজন প্রশ্নকর্তা এ ধরনের অসামঞ্জস্য আচরণ দেখাতে পারবেন না। তাঁকে একটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রে প্রতিটি অধ্যায় থেকে এবং শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত প্রতিটি শিখন উদ্দেশ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশ্ন করতে হয়। এ জন্য প্রশ্নকর্তা শিক্ষককে একটি নির্দেশক ছক অনুসরণ করতে হয়। এ ছাড়াও এ পদ্ধতিতে প্রশ্নকর্তাকে প্রতিটি প্রশ্নের একটি নমুনা উত্তরও (model answer) লিখে প্রশ্নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। আবার কোন প্রশ্নে কীভাবে নম্বর দেবেন তার নির্দেশিকাও (marking scheme) করে দিতে হয়। প্রশ্নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া এ নমুনা উত্তর এবং নম্বর প্রদান নির্দেশিকা পরে যতাযথ বিষেজ্ঞগণ যাচাইবাছাই করে ঠিক করে দেন। আবার পরীক্ষা গ্রহণের পর পরীক্ষকেরা এ নমুনা উত্তর ও নম্বর প্রদান নির্দেশিকা ব্যবহার করে প্রধান পরীক্ষকের তত্ত্বাবধানে কিছু উত্তরপত্রের নমুনা মূল্যায়ন করবেন। প্রত্যেক পরীক্ষক তাঁর বিয়য়ের ১০ থেকে ২০টি উত্তরপত্র মূল্যায়নের এ মহড়ায় অংশ নিয়ে নিজের ভুলভ্রান্তি শুধরে নেবেন। এ মূল্যায়নকে স্ট্যান্ডার্ড বা মান ধরেই ওই পরীক্ষক পরবর্তী সময় তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত অবশিষ্ট উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়ন করবেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করায় নিঃসন্দেহে মূল্যায়নপ্রক্রিয়া যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ও যথার্থ হয়।
মুখস্থবিদ্যাকে নিরুত্সাহিত করে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো এবং তার সৃজনশীলতাকে উত্সাহিত করার জন্য সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। সৃজনশীল প্রশ্নগুলো হতে হয় মৌলিক। এর যে দৃশ্যকল্প ব্যবহার করা হবে তা আগের কোনো পরীক্ষার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হতে পারবে না বা ভবিষ্যতেও আবার ব্যবহার করা যাবে না। এ দৃশ্যকল্পের বিষয়বস্তুটি অবশ্যই পাঠ্যপুস্তকের কোনো অধ্যায়ে থাকতে হবে। তবে ওই দৃশ্যকল্প পাঠ্যপুস্তক থেকে নেওয়া যেতে পারে, অন্য কোনো বই বা সংবাদপত্র থেকেও নেওয়া হতে পারে অথবা প্রশ্নকর্তা নিজেও বানিয়ে দিতে পারেন।
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিতে নমুনা উত্তর (model answer) সরবরাহের ও পরীক্ষাপূর্ব নম্বর প্রদান নির্দেশিকা (Marking scheme) এবং পরীক্ষা পরবর্তী নমুনা নম্বর প্রদানের (Sample making) ব্যবস্থা থাকায় পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট স্বচ্ছ (Transparent) ও নির্ভরযোগ্য হতে বাধ্য। বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতির মতো পরীক্ষকের ইচ্ছামতো নম্বর দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না এ ক্ষেত্রে। অর্থাত্ আগের পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে যে অনিয়ম ঘটার আশঙ্কা থাকে তা এখানে অনেকটাই কমে যাবে।
সৃজনশীল প্রশ্নের জ্ঞাননির্ভর ও অনুধাবনমূলক অংশ (ওপরের উদাহরণের প্রথম দুটি প্রশ্ন) শিক্ষার্থীরা সহজে উত্তর করতে পারবে বলে অকৃতকার্যের হারও কমে যাবে। একইসঙ্গে মেধাবী শিক্ষার্থীদের পক্ষে উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন (৩ নম্বর ও ৪ নম্বর) উত্তর করা সহজ হবে বলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার পার্থক্যও নির্ধারণ করা যায় এ পদ্ধতিতে। অথচ বর্তমান পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী মেধাবী না হয়েও কেবল মুখস্থবিদ্যার কারণেই বেশি নম্বর পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং বর্তমান পদ্ধতিতে নম্বরের পার্থক্য যোগ্যতার পার্থক্য বোঝায় না, দক্ষতার পার্থক্য দেখাতে পারে না।
সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্ন মৌলিক হওয়ায় এবং একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার নিশ্চয়তা থাকায় নোটবই বা গাইডবইয়ের আর প্রয়োজন হবে না। এতে অসাধু পন্থা অবলম্বনের প্রবণতাও কমে যাবে। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই এ পদ্ধতি মনেপ্রাণে সমর্থন করি এবং এর বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই।
ড. গাজী মো. আহসানুল কবীর: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, নায়েম। বর্তমানে এসইএসডিপি প্রকল্পে কারিকুলাম কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত।

No comments

Powered by Blogger.