'রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী ও লোকমেলা' নিয়ে কিছু কথা by বিধান দাশগুপ্ত

বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক সারথিপুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবনে, বাঙালির সামগ্রিক সংস্কৃতিতে এবং জীবনযাপনের অভিরুচিতে তাঁর প্রভাব বাইরে থেকে খুঁজলে কতটুকু পাওয়া যাবে জানি না_তবু শিক্ষিত বাঙালির অবচেতন উৎকর্ষে,


ঘরে-বাইরের ঘরানায় রবীন্দ্রনাথ এখনো সিদ্ধিদাতা! রবীন্দ্রনাথের এক শ পঞ্চাশতম জন্মদিন এবার। বহু স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহের পাশাপাশি খুলনার দক্ষিণডিহি কবিপত্নীর পৈতৃক বাড়িতে এবারও একটু ভিন্ন আঙ্গিকে অভিনবত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী পালিত হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্ আয়োজিত এ শ্রদ্ধাজ্ঞাপক দিনে জড়ো হবেন বহু বিদগ্ধ গুণী ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে মেলা বসবে। লোকমেলা। ২৫ বৈশাখ রবিবার থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে চলবে ২৭ বৈশাখ মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত। তীর্থভূমির মতো মাহাত্ম্যমণ্ডিত এই স্মরণচর্চা ও লোকমেলায় প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার রবীন্দ্রানুরাগী সমবেত হবেন বলে উৎসব আয়োজকরা মনে করেন। এ উৎসব হবে সবার এবং সবার মধ্যে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার মতো এক দুর্লভ উৎসব। মেলায় লোকজশিল্প, চারুকলা, কারুকলা, চলচ্চিত্র প্রর্দশনী, চিত্রকলা প্রদর্শনী ইত্যাদি প্রাধান্য পাবে। মোটকথা, অনুষ্ঠিতব্য উৎসবটি দলমত নির্বিশেষে সব রবীন্দ্রানুরাগী মানুষের কাছে যাতে আদৃত হয়, খুলনা জেলা ও ফুলতলা উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় সংস্কৃতসেবীরা সে প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, চিত্রপ্রদর্শনী, সেমিনার, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্যনাট্য এবং কবির গদ্যরচনা থেকে পাঠ। দূরাগত রবীন্দ্রপ্রেমীদের জন্য মেলা প্রাঙ্গণে থাকবে বিশেষ সস্তায় হোটেল-মোটেলের ব্যবস্থা। রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী ও লোকমেলা উপলক্ষে রবীন্দ্র গবেষকদের লেখা নিয়ে একটি স্মরণিকাও প্রকাশিত হচ্ছে।
খুলনার জেলা প্রশাসন ও ফুলতলা উপজেলা পরিষদ স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ইতিমধ্যে দক্ষিণডিহিতে 'রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্' নির্মাণ করেছেন। এ কমপ্লেঙ্ েথাকছে রবীন্দ্র জাদুঘর, নাট্যশালা, গ্রন্থাগার, সেমিনার কক্ষ, ইনস্টিটিউট, উন্নত টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুতায়ন-ব্যবস্থা। ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক থেকে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটি পাকা রাস্ত সংস্কারের পরিকল্পনা জেলা প্রশাসন হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির মূল ভবনের দুই পাশে স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ মূর্তি। আনুমানিক বাংলা ১২৯০ সনের ২৪ অগ্রহায়ণ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৩ বছর বয়সে দক্ষিণডিহি নিবাসী বেনীমাধব রায়চৌধুরী ও দাক্ষায়ণীদেবীর একমাত্র কন্যা 'ফুলি' ওরফে ভবতারিণীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী ফুলির নাম হয় মৃণালিনী। বেনীমাধব রায়চৌধুরী দেশ বিভাগের বহু আগে থেকে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর একমাত্র পুত্র নগেন্দ্রনাথ ওরফে 'ফেলুবাবু' জমিদারি দেখার জন্য মাঝেমধ্যে দক্ষিণডিহিতে আসতেন। ফেলুবাবুর ছেলেরা তখন কেউ দক্ষিণডিহি, কেউ কলকাতার বাসিন্দা। ১৯৪০ সালে শেষবারের মতো পরিবারের সবাই দেশত্যাগের আগে রবীন্দ্র-শ্যালক ফেলুবাবু ও তাঁর স্ত্রী নলিনীবালা দেবী বাড়িসহ আশপাশের সাত একর আট শতক জমি বাদে যাবতীয় সম্পত্তি দক্ষিণডিহির আরেক জমিদার বিজনকৃষ্ণ দাসকে বন্দোবস্ত দেন। কিন্তু বাড়ি ও বাড়ির জমি দেখাশোনার দায়িত্ব নায়েব নবকুমার মুস্তাফির ওপর অর্পিত হয়।
১৯৫৫ সালে ফেলুবাবুর পুত্র ধীরেন্দ্রকিশোর শেষবারের মতো দক্ষিণডিহিতে আসেন। ১৯৬৫ সালে বিজনকৃষ্ণ দাস দেশত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে নায়েব নবকুমার মুস্তাফির আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী, মতলববাজ মানুষ এ বাড়িটি প্রায় ৫০ বছর অবৈধভাবে দখল করে রাখে। ইতিহাসখ্যাত বেহাত হয়ে যাওয়া এ বাড়িটি ৮ মে, ১৯৯৫ জনদাবির ভিত্তিতে উদ্ধার করা হয়। রবীন্দ্র-স্মৃতিধন্য বেনীমাধব রায়চৌধুরীর পুরনো বাড়িসহ মোট সাত একর আট শতক জমির ওপর নির্মিত হয়েছে এই 'দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্'। খুলনা ও যশোর জেলার শেষ সীমানায় ফুলতলা উপজেলা পরিষদ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব কোণে এখনো একটি সমৃদ্ধ গ্রাম দক্ষিণডিহি। গঙ্গা থেকে বেরিয়ে নানা জনপদ পেরিয়ে কুষ্টিয়া ও যশোরকে পেছনে ফেলে ভৈরব নদ ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহিকে স্পর্শ করেছে।
'কিন্তু কোনো কাজেরই সফল রূপায়ণ এ যাবৎ হয়নি, আমলাতান্ত্রিক মাড়াইযন্ত্র সব উৎসাহ-উদ্যোগের রস নিংড়ে নিয়েছে। আর সে কারণে সব প্রক্রিয়াই একটা অচল অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছে'_এ কথা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী ও লোকমেলা-২০১১ উদ্যাপনে উৎসাহী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক রবীন্দ্রভক্ত। তিনি আরো বললেন, '২৫ বৈশাখ যখন ঘাড়ের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে, তখনই রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্রে কাজকর্ম শুরু হয়, এতে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্রে দায়িত্বভার জেলা প্রশাসনের হাতে ন্যস্ত। এ কারণে জেলা প্রশাসনের উচিত, স্থানীয় কমিটি করে তাদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে সহযোগিতা করা।... কিন্তু এবার একটু ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাচ্ছি।' তিনি তাঁর বক্তব্যে আরো উল্লেখ করেন, বর্তমান জেলা প্রশাসক জমসের আহম্মেদ খন্দকার একজন সংস্কৃতিবান ও শিল্পী মানুষ। তিনি রবীন্দ্রপ্রেমী। স্থানীয় সংসদ সদস্য নারায়ণচন্দ্র চন্দর আন্তরিক সহযোগিতায় এবারের সার্ধশততম জন্মোৎসব ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে। সঙ্গে আছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি, রবীন্দ্রপ্রেমী কাজী খেলাফাত হোসেন বাচ্চু ও কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার ভৌমিক। গাছগাছালির ঘেরাটোপে বন্দি পুরনো দোতলা বাড়ি। বাড়ির থামগুলো বেশ চৌকস, প্রাচ্যরীতির কারুকাজ। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব থাকলেও কবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে সংস্কার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এ বাড়িতে বিশ্বকবির জীবনের এক স্বর্ণবেলা কেটেছে। এ বাসগৃহে সঞ্চিত হয়ে আছে কবি জীবনের অনেক মৌনস্মৃতি। গবেষকরা বলেন, এ বাড়িটিও রবিঠাকুরকে দিয়েছিল শিল্পের দীক্ষা। শিল্পের চিত্রভাষ্য রচনায় কোথাও কোথাও তিনি এ নিভৃত গ্রামকে সুনিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন। এ বাড়িটি ঘিরে এবার পালিত হচ্ছে কবির এক বর্ণাঢ্য সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী ও লোকমেলা। এ উৎসব সবার; ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের।
লেখক : সম্পাদক, সংস্কৃতিবাজার ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.