অভিমত by শেখ আলী

সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র
এমাজউদ্দীন আহমদের লেখা ‘সংবিধান সংশোধন, না ৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন?’ শিরোনামে একটা লেখার সুবাদে আমার কয়েকটি কথা:

আমার মতে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া বা বিভিন্ন প্রকার সংশোধনীর পর যে সংবিধান বর্তমানে বিদ্যমান, তার কোনোটিই বাংলাদেশের সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে যে মৌলিক বিষয়টি থাকা দরকার, সেটার অনুপস্থিতিই লক্ষ করা যায়।
১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে পদ্ধতিগত দিক হিসেবে প্রয়োজন ছিল মুক্তিযুদ্ধে প্রতিফলিত জনগণের আকাঙ্ক্ষার লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ‘সংবিধান সভা’র নির্বাচন করা। নির্বাচিত এই ‘সংবিধান সভা’ সংবিধান প্রণয়ন করে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয়। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে নিজ দেশে জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করা। যে সাংবিধানিক নীতি-কাঠামোর মধ্যে এ কাজটি সফলভাবে করা যায়, তাকেই বলা যেতে পারে গণতান্ত্রিক সংবিধান। সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি কল্পনামাত্র। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এই কল্পজগতেই আমাদের বসবাস। নিজ দেশের সম্পদ, বাজার ও উত্পাদন-সৃষ্ট মুনাফার ওপর সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক বৃহত্ পুঁজির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার মতো অর্থনৈতিক নীতি অবলম্বন করে আমরা কেউ এ দেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের, কেউবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। মূলগতভাবে একই অর্থনৈতিক নীতি অবলম্বন করে জনগণের পিছিয়েপড়া মানসিকতাকে বিভিন্নভাবে উস্কে দেওয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করে বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক কারণেই সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর স্বার্থ রক্ষায় তত্পর এ দেশের ধনিক শ্রেণী তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। ফলে এ দেশের ধনিক শ্রেণীর মধ্যে জাতীয় চরিত্র সুগঠিত রূপ নেয়নি। ধনিক শ্রেণীর জাতীয় চরিত্রের সংগঠিত রূপ ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর অবদান রাখতে পারে না, সেটা বাংলাদেশের গত ৩৯ বছরের ইতিহাস লক্ষ করলেই বোঝা সম্ভব। অর্থাত্ এ দেশের ধনিক শ্রেণীর বিজাতীয় চরিত্রের কারণে সংসদীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সংসদের ওপর জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগকে নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিকভাবে জাতীয় ধনবাদ বিকাশের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের জন্য জাতীয় ধনবাদ বিকাশের শর্তকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচিত সংসদীয় প্রতিনিধিদের জন্য তা সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক করা। নির্বাচিত সংসদীয় প্রতিনিধিরা এর বরখেলাপ করলে, তার প্রতিবাদে জনগণের আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার প্রদান করা। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জনগণের এই অধিকারকে নাকচ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে, সেখানেই অনুচ্ছেদ ৮-এর উপঅনুচ্ছেদ ২-এ বলা হয়েছে, ‘এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূল সূত্র হইবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য হইবে না।’
অর্থাত্ নির্বাচিত সংসদীয় প্রতিনিধিদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে জনগণের অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সংসদকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। পাশাপাশি এই একই সংবিধানে প্রথম ভাগে সংবিধানের প্রাধান্য নামক অনুচ্ছেদ ৭-এর উপঅনুচ্ছেদ ১-এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে, জনগণ না সংসদ—এটা পরিষ্কার নয়। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ—এর অর্থ হচ্ছে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু সেই জনগণের অধিকার খর্ব করা হয়েছে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
এ ক্ষেত্রে এমাজউদ্দীন আহমদ একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে এনেছেন এই বলে, বাংলাদেশ সংবিধানের সর্বোত্তম বাক্যটি হলো, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ অনুচ্ছেদ ৭(১)। অনেকের মতে, সবচেয়ে অর্থহীন হলো এই বাক্যটি। কেননা নির্দিষ্ট সময়ে কিছু ব্যক্তির ভোটদানের অধিকার ছাড়া এই মালিকানার কোনো অর্থ নেই।
মো. মতিন উদ্দিন
রাজশাহী।

অভিবাসী শ্রমিকের সাফল্য
অভিবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সবচেয়ে বড় অবদানের অল্প-বিস্তর স্বীকৃতি ও প্রশংসা জোটে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতেও এই বিশাল জনশক্তির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, এ কথা কমই উচ্চারিত হয়। দেশের অনেক স্থানে অভিবাসী শ্রমিকদের অবদানে গড়ে উঠেছে নতুন দোকানপাট, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, কৃষি বা মত্স্য খামার, কারখানা ইত্যাদি।
তবে বিদেশ থেকে অর্জিত টাকা ভোগবিলাসে খরচ করে অনেক প্রবাসী শ্রমিকের পরিবার। কয়েক বছর বিদেশে থেকে যে টাকা উপার্জন করেন, দেশে ফিরে সে টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করেন শ্রমিক নিজেও। এ চিত্রটিই বেশি। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে।
‘ফিরে আসা অভিবাসীদের সাফল্যকথা’ শিরোনামে ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ ইউনিট-রামরু’র আয়োজনে সম্প্রতি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় নিজেদের সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন এসব ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিক। টাঙ্গাইলের কালিহাতীর আলাউদ্দিন তাঁদের একজন। ১৯৮৮ সালের বন্যায় তাদের পারিবারিক ব্যবসায় তাঁত মেশিনগুলো ডুবে গেলে এসএসসি পাস আলাউদ্দিন ধারকর্জে ৭৮ হাজার টাকা সংগ্রহ করে সেবছরই চলে যান জাপানে। সেখানে চার বছর পরিশ্রম করে ১৯৯২ সালে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। সেই টাকা ব্যবসায় খাটান। এখন তিনি ছয় তলার একটি বাণিজ্যিক ভবনের মালিক। অতীত ব্যবসা ধরে রাখতে একটি তাঁত কারখানা বসিয়েছেন, দুটি ফিশারিজ প্রজেক্ট রয়েছে, আছে আরও কিছু ছোট ব্যবসায়ী উদ্যোগ। এসবের পেছনে ২০ থেকে ২৫ জনের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আর আলাউদ্দিনের সম্পদের মূল্য দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কুমিল্লার মুরাদনগরের স্বল্পশিক্ষিত মজলু মিয়া সংসারের অভাব দূর করতে টাকা ধার করে ১৯৯৩ সালে কুয়েত যান। সেখানে ১৪ বছর কাটিয়ে ২০০৭ সালে দেশে ফিরে ১৪টি পুকুর লিজ নেন। এখন বিশাল মত্স্য চাষ প্রকল্প তাঁর। সেখানে ২০ জন কর্মচারীর স্থায়ী কর্মসংস্থান। আর মজলু মিয়া এখন স্থানীয়ভাবে শীর্ষ ধনীদের একজন। ঢাকার নবাবগঞ্জের ফণীন্দ্র রায় মালয়েশিয়ায় চার বছর কাজ করে দেশে জমানো অর্থ দিয়ে ইলেক্ট্রনিকসের ব্যবসা শুরু করেন। এখন একজন ভালো রেডিও-টিভি মেকার হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। ঢাকার কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা গ্রামের মো. রুহুল আমিন অর্থ আয়ের পাশাপাশি বিদেশ থেকে অর্জিত টাকায় একটি হাসপাতাল দিয়েছেন। এ ছাড়া একটি শপিং কমপ্লেক্সের মালিক তিনি। কুমিল্লার দাউদকান্দির খোশকান্দি গ্রামের হালিম চৌধুরীর একটি ফিডস মিল, মসলা কারখানা, বিশাল এলাকাজুড়ে মত্স্য চাষ প্রকল্প রয়েছে।
কেবল ফিরে আসা শ্রমিক নিজেই নন, তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও অর্থের সঠিক ব্যবহার করে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন। টাঙ্গাইলের কালিহাতির সুরাইয়া আখতার স্বামীর পাঠানো টাকা দিয়ে পোলট্রি ফার্ম করেছেন, মাইক্রোবাস কিনেছেন, দোকান বসিয়েছেন, যা তিনি নিজেই দেখাশোনা করেন।
গত আগস্টে রামরুর আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে হালিম চৌধুরী, রুহুল আমিন ও সুরাইয়া বেগমের হাতে ‘সোনার মানুষ সম্মাননা’ পুরস্কার তুলে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, অভিবাসী শ্রমিকেরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, আর যাঁরা ফিরে এসে সে অর্থ আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই সোনার মানুষ। তবে বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা ভোগবিলাসে উড়িয়ে দেওয়া পরিবারের সংখ্যা এখনো বেশি। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে যাঁরা সাফল্যের উদাহরণ তৈরি করেছেন, তাঁদের কথা আরও বেশি করে তুলে ধরা উচিত।
মাহমুদ মেনন
ঢাকা।

যানজট অবশ্যই কমানো সম্ভব
প্রতিদিন এক দুর্বিষহ জীবন শুরু হয় ঢাকাবাসীর। ইদানীং এ যন্ত্রণা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ঘর থেকে বের হলে নিশ্চিত করে বলা যাবে না কখন গন্তব্যে পৌঁছব। পিঁপড়ার মতো লাইন বেঁধে চলছে অসংখ্য গাড়ি। ১৫ মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লাগছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, কত জ্বালানির অপচয় হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নানা রোগব্যাধি। ক্যানসার, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, কিডনি অকার্যকর ইত্যাদি বাড়ছে। যানজটের ফলে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন হাঁপনি, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হূদরোগে আক্রান্ত বিশেষ করে বয়স্ক মানুষেরা।
যানজট সমস্যার সমাধানে সরকার কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে যেমন পাতালরেল, মনোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। এগুলো বাস্তবায়নে অনেক সময়ের প্রয়োজন। এই মুহূর্তে যানজট সমস্যা লাঘব করার উপায় যে একেবারে নেই, তা নয়। জরুরিভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি অবশ্যই হতে পারে।
যেমন: ১. রাস্তার দুপাশের ফুটপাথগুলো অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করা। ২. ১৫ বছরের পুরোনো ও অযোগ্য সব যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা এবং এসব যানবাহন রাস্তায় ধরা পড়লে সেগুলো আটক করে তার মালিকদের বিশাল অঙ্কের জরিমানা করা। ৩. ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে মেনে চলার ব্যপারে কঠোর পদেক্ষপ নেওয়া। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার শাস্তি আরও কঠোর করা। জরিমানার হার বাড়ালে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা কমবে। ৪. ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা যাতে অনৈতিক চর্চা না করেন সেজন্য ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা। ৫. প্রাইভেট কারসহ ছোট যানবাহনের সংখ্যা যাতে আর না বাড়ে সেদিকে প্রশাসনের কার্যকর দৃষ্টি দরকার। একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের প্রাইভেট কার ব্যবহার না করাই ভালো। এ বিষয়ে একটি আইন বা বিধান করা যেতে পারে। ৬. বড় আকারের বাসসহ একসঙ্গে অনেক যাত্রী পরিবহন করতে পারে এমন যানবাহন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া। ৭. স্বল্প দূরত্বে রিকশা, বাস ইত্যাদি ব্যবহার না করে হাঁটার অভ্যাস করলে রাস্তায় যানবাহনের চাপ কিছুটা হলেও কমবে, বিশেষ করে রিকশার সংখ্যা যাতে আর না বাড়ে সেদিকে দৃষ্টি রেখে সচেতন নাগরিকদের হাঁটার অভ্যাস করা উচিত। তবে সেজন্য হাঁটার উপযোগী ফুটপাথের প্রয়োজন; ফুটপাথ দখলমুক্ত করে এটা অবশ্যই করা সম্ভব।
মনজু আরা বেগম
সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, ঢাকা।

ভূমিদস্যুদের তাড়ানো দরকার
গত ১০ জানুয়ারি রিহ্যাব ও বাংলাদেশ ভূমি উন্নয়ন সংস্থার (বিএলডিএ) নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান এক গৃহায়ণ ব্যবসায়ীকে বলেন, ‘ভূমিদস্যু উপাধি নিয়ে রাতে ঘুমান কী করে?’ বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের একটি মন্তব্যের জবাবে প্রতিমন্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা বলছেন, আপনারা এই গৃহায়ণ খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন; কিন্তু এই ৭০ হাজার কোটি টাকা আপনারা কোথায় পেলেন? আপনারা ২০-২৫ বছর আগে কে কী ছিলেন?’ প্রশ্নটি খুবই যথার্থ।
প্রতিমন্ত্রী ভূমিদস্যুতা ও মানুষের সঙ্গে প্রতারণার যেসব উদাহরণ উল্লেখ করেছেন সেগুলো যথার্থ। খাসজমি দখল, মানুষজনকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বাড়িঘর থেকে উত্খাত, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাটবাড়ি হস্তান্তর না করা—এসব তো গৃহায়ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু ভূমিদস্যুর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমার স্ত্রী দুই ভূমিদস্যুর খপ্পরে পড়ে কীভাবে হয়রান হয়েছেন তার বর্ণনা দিচ্ছি। সাভারে অবস্থিত এক হাউজিং প্রকল্পে আমার স্ত্রী ১৯৯৬ সালে রেজিস্ট্রেশন দলিলমূলে তিন কাঠার একটি প্লটের মালিক হন। কিন্তু এই হাউজিং কোম্পানির মালিক দুই ভাই আমার স্ত্রীকে প্লটটা বুঝিয়ে দেন না। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁরা নানাভাবে ঘোরাতে থাকেন; টেলিফোন করলে টেলিফোন ধরেন না, চিঠি লিখলে জবাব দেন না, দেখা করার সময় দিয়ে নির্ধারিত তারিখে উপস্থিত থাকেন না। এমনভাবে চলতে থাকে ১০ বছর। অথচ প্লটের দাম ১৯৯৬ সালের আগেই পরিশোধ করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে এক উপদেষ্টার সাহায্য নিই। তিনি সাভারের টিএনওকে বিষয়টি দেখার জন্য নির্দেশ দেন। টিএনও সাহেব তাঁর দুজন সার্ভেয়ারকে নিয়ে সরেজমিনে এই হাউজিং এস্টেটে গিয়ে দেখেন, যে প্লটটি আমার স্ত্রীকে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হয়েছে, সেটি পরে অন্যের কাছে আবার বিক্রি করা হয়েছে; সেই প্লটটি তখন নতুন ক্রেতার দখলে। আমার স্ত্রীর নামে সেখানে কোনো প্লট নেই। টিএনও সাহেব আমাকে জানান, হাউজিং এস্টেটের এক কোনায় পৌনে তিন কাঠার মতো একটি জায়গা পাওয়া গেছে, সেটি যেন আমার স্ত্রী নিয়ে নেন। আমার স্ত্রী বাধ্য হয়ে ওই পৌনে তিন কাঠার প্লটটি গ্রহণ করেন, অথচ তিনি ১৯৯৬ সালের আগেই পুরো তিন কাঠা জমির মূল্য পরিশোধ করেছেন। উপরন্তু এই প্লটটির জন্য একটি নতুন রেজিস্ট্রেশন দলিল সম্পাদন করতে হয় আমার স্ত্রীর টাকায়। আমরা আগে-পরে জানতে পেরেছি, এই হাউজিং এস্টেটে যাঁরা প্লট কিনেছেন, তাঁদের অনেকেই এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এর মালিক দুই ভাই বিদ্যুত্, রাস্তাঘাট, নানা রকমের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে নতুন করে প্লট ক্রেতাদের কাছে টাকা চেয়ে যাচ্ছেন।
এই প্রতারণার বিপরীতে এখন অন্য রকমের একটি উদাহরণ দিচ্ছি। একটি গৃহনির্মাণ কোম্পানি আমার উত্তরার প্লটে বাড়ি নির্মাণ করছে যৌথ উদ্যোগে। নির্ধারিত সময় থেকে তারা তিন মাস পিছিয়ে পড়েছে বলে অতিরিক্ত লোক লাগিয়ে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করে ফ্ল্যাটগুলো হস্তান্তর করবে বলে তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছে। তাদের কথায় আমি বিশ্বাস করি; কারণ, এর আগে এই কোম্পানিটি অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন ও প্রয়াত সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদের বাড়িও নির্মাণ করেছে।
ভূমিদস্যুদের বিপরীতে হাউজিং খাতে সত্ ব্যবসাও চলছে। প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ভূমিদস্যুদের তাদের সংগঠন থেকে তাড়িয়ে সেখানে সত্ ব্যবসায়ীদের উত্সাহ দেওয়ার কথা বলেছেন।
ভূমিদস্যুদের দাপট কমানোর এটাই আসল পন্থা।
মহিউদ্দিন আহমদ, উত্তরা, ঢাকা।

বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা
দেশের অধস্তন বিচারলয়ে বিচারক নিয়োগ হয় বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। সহকারী বিচারক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়োগ পান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন দলীয় বিবেচনায়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো বালাই নেই। সুপ্রিম কোর্টের দুটি বিভাগ—হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ। প্রথমে হাইকোর্ট বিভাগের অস্থায়ী বিচারক নিয়োগ, পরে স্থায়ীকরণ থেকে আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনাই বড় হয়ে থাকে। সংবিধানের ৯৫ (২) (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টে যে কেউ ১০ বছর অ্যাডভোকেট হিসেবে প্রাকটিস করলে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে যোগ্য হবেন। তবে হাইকোর্টে প্রাকটিস করার জন্য নূন্যতম দুই বছর অধস্তন কোর্টে প্রাকটিসের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাই সহজেই বলা যায়, কোনো ব্যক্তি ১২ বছর আইন পেশায় থাকলে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
১৯৮০-এর দশক থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির কথা বলি আর বার কাউন্সিলের কথাই বলি, সবই রাজনৈতিক মতাদর্শে দ্বিধাবিভক্ত। বিভিন্ন মামলা লক্ষ করলে এর আভাস মেলে।
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘ ৩৫ বছর সময় লেগেছে। হাইকোর্টের বিচারকেরা বিব্রতবোধ করেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার করতে। দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ হওয়ার ফলে এমনটি ঘটেছিল বলে আমার ধারণা। ২. বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা ও যোগ্যতাকে বিবেচনায় না আনার কারণে বিচারপতি ফয়েজী জাল বা নকল সার্টিফিকেট দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতো জায়গায় বিচারপতি হয়ে বিচারকার্যও পরিচালনা করেছেন। ৩. দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের ফলে নিজ দলের নেতাদের আগাম জামিন ও তাদের স্বার্থ বেশি সংরক্ষণের প্রবণতা থাকা অসম্ভব নয়। ৪. গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষের দিকে এক সঙ্গে প্রায় ৩০০ মামলার রায় হয় খুব অল্প সময়ে। এতে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি সাধারণ জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বর্তমান সরকারের প্রতি আকুল নিবেদন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের দলীয় বিবেচনায় না নিয়ে যেন সত্, যোগ্য, পরিশ্রমী, সাহসী প্রার্থীদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো সত্, যোগ্য ও নির্ভীক বিচারপতি তৈরি হবে। যাঁরা বিচারপতি হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে অলংকৃত করবেন।
মো. মোকাররম হোসেন
পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বেদেরা কত দিন উপেক্ষিত থাকবে?
বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় এ সমাজেরই একটি অংশ। তাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। তারা সাধারণভাবে সুবিধাবঞ্চিত একটি সম্প্রদায়, যাদের শতকরা ৯৮ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ৯০ শতাংশ এখনো নিরক্ষর। বেদে নারীদের মধ্যে নিরক্ষরতার হার বেশি। বেদে শিশুদের টিকা নেওয়ার হার মাত্র ২ শতাংশ।
বেদে সমাজ গ্রাম্য কৃষক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। এরা প্রধানত চুড়ি-ফিতা-খেলনা বিক্রি করে। সিংগা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, তাবিজ-কবজ, সাপে কাটা রোগীর চিকিত্সা, ভেষজ চিকিত্সা, বানর খেলা প্রভৃতি কাজে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এ বৈচিত্র্যময় যাযাবর জনগোষ্ঠী আমাদের প্রাচীন বাংলার সমাজিক ঐতিহ্যের অংশ। বেদেরা প্রায় ১০ মাস ধরে জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। ওরা পরিত্যক্ত জমি, নদীর পাড়ে. রাস্তার ধারে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেয়। কেউবা বছরের পর বছর ধরে নৌকায় বাস করে। দেশের প্রায় ৭৮টি স্থানে ২ মাসের জন্য বেদেরা জড়ো হয়। এ সময় তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা, বিয়ে-শাদি দেওয়া ও পরবর্তী পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত হয়।
যারা নৌকায় বাস করে তাদের অবস্থা বেশ করুণ। এখন আর ১২ মাস নদীতে থাকা যায় না। দেশের বড় নদীগুলো ক্রমে শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নৌকা ছেড়ে ডাঙায় পলিথিনের ঘর বেঁধে থাকতে হয়। সরকার সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিত্সা, বাসস্থান নিশ্চিত করার কথা বললেও বেদে সম্প্রদায়ের কথা কেউ ভাবে না। প্রাপ্তবয়স্কদের কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তাঁরা ভোটার তালিকায় স্থান পান না, ভোট দিতে পারেন না। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেদে শিশুকে ভর্তি করে না।
দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ শিশুকে টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে আনা হয়েছে, কিন্তু বেদে শিশুদের মধ্যে এখনও টিকা গ্রহণের হার মাত্র দুই ভাগ। শিশুদের ছয়টি মারাত্মক রোগ পোলিও, হাম, হুপিংকাশি, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা ও ধনুষ্টঙ্কারের টিকা কিভাবে নেওয়া হয় তা বেদেরা জানে না। বেদে সমাজের বিশেষ করে নারী ও শিশুরা অপুষ্টির শিকার এবং অপুষ্টিজনিত নানা অসুখে ভুগছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অপর্যাপ্ততা, অসুস্থ পরিবেশে খাওয়া-গোসল করায় বছরজুড়েই তারা অসুস্থ থাকে। প্রায় ১০ লাখ বেদে সমাজের সবাই বিচ্ছিন্নভাবে ১০ মাস খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করে। বছরের দুই মাস যেখানে ঘর বেঁধে থাকে, সেখানে প্রথাগত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকে না। এতে ওইসব এলাকায় ডায়রিয়া ও জ্বর মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার ২০১০ সালের মধ্যে সবার জন্য একশত ভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। বেদে সমাজ কি আমাদের সমাজের বাইরে? সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, উপেক্ষিত, বৈষম্যের শিকার বেদে সম্প্রদায়েরও জাতীয় উন্নয়নে অংশ নেওয়ার অধিকার আছে।
শেখ আলী, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.